লকডাউন নিয়মকে তুড়ি মেরে এইচআইভি শিশুদের নিয়ে অনুষ্ঠান, বিতর্কে সাংসদ মিমি ও এসপি

  • এবার লকডাউন নিয়ে খোদ কাঠগড়ায় সাংসদ ও পুলিশ সুপার
  • সাংসদ মিমি চক্রবর্তী এবং পুলিশ সুপার রশিদ মুনির খান
  • অভিযোগ, ১৫টি-রও বেশি এইচআইভি আক্রান্ত শিশু-কে বিপদের মুখে ফেলা হয়েছে
  • যাদের রোগ প্রতিরোধের ক্ষমতা কম তাদের জন্য করোনাভাইরাস অতি বিপজ্জনক

Asianet News Bangla | Published : Apr 15, 2020 2:57 PM IST / Updated: Apr 16 2020, 01:29 AM IST

উদ্দেশ্য ছিল পয়লা বৈশাখে এইচআইভি পজিটিভ শিশুদের বিশেষ মুহূর্ত উপহার দেওয়া। কিন্তু, এতেই এখন বেঁধেছে বিতর্ক। কারণ, এই কাজ করতে গিয়ে লকডাউন-এর নিয়ম-কে তুড়ি মেরে তো ওড়ানোই হয়েছে, সেই সঙ্গে করোনাভাইরাসের এই দ্রুত সংক্রমণের সময় এক দল বহিরাগত-র সংস্পর্শে এসে পড়েছে একদল এইচআইভি পজিটিভ শিশু। এখানেই শেষ নয়, এই শিশুদের সঙ্গে কাটানো মুহূর্তের ছবি ক্যামেরা ও ভিডিওবন্দি তো করা হয়েছে, সেইসঙ্গে তা ফেসবুকেও ফলাও করে পোস্ট করা হয়েছে। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশিকা অনুসারে কোনওভাবেই এইচআইভি পজিটিভ-দের পরিচয়, এমনকী ফেসিয়াল রেকোগনিশনও প্রকাশ্যে বা পাবলিকলি প্রচার করা যায় না। এক্ষেত্রে এমন দায়িত্ব-জ্ঞানহীন কাজ কীভাবে সংঘটিত হল? এর কোনও সদুত্তর পাওয়া যায়নি। তবে, এই ঘটনায় মূলত তিনটি দিকে আঙুল উঠেছে- যাদবপুর লোকসভা কেন্দ্রের সাংসদ মিমি চক্রবর্তী, বারুইপুরের এসপি রশিদ মুনির খান এবং অবশ্যই শিশু-রা যে হোমে থাকে তার প্রধান কল্লোল ঘোষ-এর দিকে। 
করোনা সংক্রমণে 'রেড মার্কিংয়ে' কলকাতা, আতঙ্ক বাড়়ালো স্বাস্থ্য় মন্ত্রকের তালিকা.

যদিও, কল্লোল ঘোষ যাবতীয় অভিযোগই অস্বীকার করেছেন। তাঁর মতে, লকডাউনের পুরো নিয়ম এবং সোশ্যাল ডিস্ট্যান্সিং-এর নিয়ম মানা হয়েছিল। তাহলে যে ছবি এবং ভিডিও এশিয়ানেট নিউজ বাংলার হাতে এসেছে সেখানে কোথাও সোশ্যাল ডিস্ট্যান্সিং মানার ছবি ধরা পড়েনি। উল্টে দেখা গিয়েছে অধিকাংশ ছবিতেই শিশুদের মুখে মাস্ক বা গ্লাভস নেই। তাদের ঘিরে দাঁড়িয়ে রয়েছেন খোদ বারুইপুর পুলিশ জেলার এসপি রশিদ মুনির খান এবং তাঁর দলবল। এমনকী এই ভিড়ের মধ্যে ছিলেন সাংসদ মিমি চক্রবর্তীর প্রতিনিধিরাও। এনজিও-র প্রধান কল্লোল ঘোষ আবার জানেন না যে তাঁর হোমের শিশুদের ছবি ফেসবুকে পোস্ট হয়ে যাওয়ার কথা। এইআইভি আক্রান্ত শিশুদের ছবি কীভাবে পাবলিকলি পোস্ট করে দেওয়া হল- তার কোনও উত্তর তিনি দিতে পারেননি। এশিয়ানেট নিউজ বাংলা ওই শিশুদের কথা ভেবে এবং সুপ্রিমকোর্টের নির্দেশিকাকে সম্মান জানিয়ে সেই সব ছবি এখানে পোস্ট করতে পারেনি। কারণ, এশিয়ানেট নিউজ বাংলা দায়িত্ব-জ্ঞানহীনের মতো কাজ করতে চায় না।
রাজ্য়ে করোনা টেস্ট কম কেন, জবাব দিলেন মুখ্য়মন্ত্রী..

পয়লা বৈশাখ উপলক্ষে মঙ্গলবার দুপুরে সোনারপুরের এই হোমে একটি অনুষ্ঠান রাখা হয়। যেখানে এইআইভি পজিটিভ শিশুদের জন্য নানা ধরনের উপহার নিয়ে হাজির হন রশিদ মুনির খান। যিনি বারুইপুর পুলিশ জেলার পুলিশ সুপার। তাঁর সঙ্গে তাঁর অধস্তন অফিসাররাও ছিলেন। ছিলেন সোনারপুর থানার আইসি-ও। এদিকে যাদবপুর লোকসভা কেন্দ্রের সাংসদ মিমি চক্রবর্তীর-ও সেখানে হাজির হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু, লকডাউনের কথা ভেবে তিনি শেষমুহূর্তে সেখানে যাওয়া বাতিল করেন। পরিবর্তে তিনি তাঁর আপ্ত-সহায়ক অনির্বাণ ভট্টাচার্য-কে সেখানে পাঠান শিশুদের জন্য পোশাক নিয়ে। এই অনুষ্ঠানের জন্য মিমি আবার ভিডিও শ্যুট-ও করেও হোম কর্তৃপক্ষকে পাঠান। আবার পুরো অনুষ্ঠানকে স্মরণীয় করে রাখতে মিডিয়া, ক্যামেরাম্যান সবাইকে ডাকা হয়। একদল মানুষ মুহূর্তের মধ্যে সেই হোমের মধ্যে ঢুকে পুরো অনুষ্ঠানকে ক্যামেরাবন্দি করে রাখে। এই পরিস্থিতি-র মধ্যেই এইচআইভি শিশুরা ঘোরাফেরা করে। বলতে গেলে হোমের ভিতরে এক মেলা বসে যায়। করোনাভাইরাসকে প্রতিরোধ করতে একসঙ্গে যে কোনও জমায়েতের উপরে নিষেধাজ্ঞা জারি করে রাখা হয়েছে। এমনকী, বুধবার কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক থেকে লকডাউন-২-এর যে নির্দেশিকা জারি করা হয়েছে তাতেও যে কোনও ধরনের জমায়েতের উপর নিষেধাজ্ঞা বলবৎ রাখার কথা বলা হয়েছে। অথচ, একজন দায়িত্ববান জনপ্রতিনিধি হিসাবে সাংসদ মিমি চক্রবর্তী এবং একজন দায়িত্ববান পুলিশ অফিসার হিসাবে রশিদ মুনির খান কীভাবে এই বিষয়গুলি ভুলে গেলেন তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। এমনকী, হোমের প্রধান কল্লোল ঘোষ-ও বা কীকরে এমন এক জটিল পরিস্থিতি এতগুলো শিশুকে একদল বহিরাগত যারা হোমের ভিতরে সঠিকভাবে স্যানিটাইজেশন না করেই প্রবেশ করেছিল তাদের সামনে বের করেছেন- তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। 
২০ এপ্রিল থেকে খুলছে রাজ্য়ের সব চটকল, কেন্দ্রের কথায় সায় মমতার.

এমনকী, অভিনেত্রী তথা সাংসদ মিমি চক্রবর্তী আসতে পারেন শুনে আশপাশের এলাকা থেকেও অসংখ্য মানুষ হোমের সামনে ভিড় করেছিলেন। খোদ হোমের প্রধান কল্লোল ঘোষ জানিয়েছেন, ভিড়় দেখে কোলাপসেবল গেটের একটা অংশ খুলে সেখান দিয়ে এসপি এবং সাংসদের প্রতিনিধিদের ভিতরে প্রবেশ করানো হয়েছিল। এমন এক বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি- তাও আবার তার সাক্ষী খোদ পুলিশ সুপার! স্বভাবতই পুরো ঘটনাকেই একটা চূড়ান্ত পর্যায়ে দায়িত্ব-জ্ঞানহীনতা-র বলে দাবি করা হচ্ছে। নাম ও পরিচয় প্রকাশে অনিচ্ছুক এক সরকারি আধিকারিকও জানিয়েছেন, কোনওভাবেই এইআইভি পজিটিভদের পরিচয়-কে পাবলিকলি প্রকাশ করা যায় না। এক্ষেত্রে আর এটা করা যায় না কারণ এরা সকলেই নাবালক। বিষয়টি নিয়ে নারী ও শিশু কল্যাণ মন্ত্রী শশী পাঁজাকেও ফোন করা হয়েছিল এশিয়ানেট নিউজ বাংলার পক্ষ থেকে। বহুবার ফোন করেও মন্ত্রীকে পাওয়া যায়নি। কারণ, তাঁর ফোন লাগাতার ব্যস্ত ছিল। ফোনে যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হয় নারী ও শিশু উন্নয়ন এবং সমাজ কল্যাণ দফতরের সচিব সঙ্ঘমিত্রা ঘোষের সঙ্গে। কিন্তু, এই দফতরের দেওয়া ল্যান্ড-লাইন নম্বরটি অকেজো থাকায় তাঁকেও পাওয়া যায়নি। এরপর শিশু অধিকার দফতরের ডেপুটি ডিরেক্টর সুপ্রিয় সরকার-এর সঙ্গে এশিয়ানেট নিউজ-এর পক্ষ থেকে কথা বলা হয়। সমস্ত বিষয়টি শুনে তিনি রীতিমতো ঝাঁঝালো ভাবে জানিয়ে দেন- এসব শোনা তাঁর কাজ নয়, বরং দফতরের সচিবকে ফোন করতে বলে লাইন কেটে দেন। শিশু অধিকার লঙ্ঘনের মতো যেখানে বিষয় সেখানে একজন ডেপুটি ডিরেক্টর কীভাবে লাইন কাটতে পারেন- তা সত্যিকারেই অবাক করে দেয়। 

স্থানীয় সূত্রে খবর গত কয়েক দিন ধরেই বারুইপুর পুলিশ সুপার রশিদ মুনির খান বিভিন্ন হোমে গিয়ে শিশুদের সঙ্গে দেখা করে তাঁদের খাবার-দাবার বিলি করে আসছেন। পুলিশ মহল সূত্রে দাবি করা হয়েছে, এসপি-র কাছে এইচআইভি শিশুদের রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতার কমের বিষয়টি এবং এই ধরনের অনুষ্ঠানে তাদের ক্ষতি হতে পারে এটা পরিস্কার ছিল না। যার জন্য তিনি অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছিলেন। কিন্তু, তাহলে ফেসবুকে কীভাবে এইচআইভি আক্রান্ত শিশুদের ছবি পোস্ট করে দিলেন রশিদ মুনির খান। এক্ষেত্রে দাবি করা হয়েছে যে পুলিস সুপার নিজে বারুইপুর পুলিশ সুপারের পেজটি সবসময় নিয়ন্ত্রণ করেন না, তাদের দফতরের কেউ এটা করে থাকেন। তিনি না বুঝেই ছবিগুলি হয়তো আপলোড করে দিয়েছিলেন। 

লকডাউন নিয়ম যে লঙ্ঘিত হচ্ছে তা নিয়ে ইতিমধ্যেই কেন্দ্র থেকে রাজ্য সরকারকে চিঠি দেওয়া হয়েছে। অথচ, শাসকদলের এক সাংসদ এবং পুলিশ প্রশাসনের এই উচ্চ-পদস্থ কর্তার অনুষ্ঠানেই লকডাইন নিয়ম না মানার অভিযোগ। করোনাভাইরাস নিয়ে সমানে সামনে আসছে একের পর এক গবেষণাপত্র। সেখানে বারংবার বলা হচ্ছে- যাদের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা কম তাদের আইসোলেশনে রাখতে। এমনকী রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বলদের তালিকায় এইচআইভি আক্রান্তদেরও রাখা হয়েছে। সুতরাং, কিছু লোকের দায়িত্ব-জ্ঞানহীনতায় কিছু এইচআইভি পজিটিভ শিশু এখন কঠিন পরিস্থিতির সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে বলেও অনেকে অভিযোগ করছেন। পরবর্তীতে এদের মধ্যে কেউ করোনাভাইরাসের সংক্রমণে আক্রান্ত হলে তার দায়-ভার কে নেবেন- সাংসদ মিমি চক্রবর্তী না পুলিশ সুপার না হোমের প্রধান কল্লোল ঘোষ?  

Share this article
click me!