তৃতীয় বিশ্বের মানুষের মধ্যে দিয়ে বয়ে যায় "অন্তর্বর্তী নদী", অনুবাদ-শময়িতা চক্রবর্তী, সমালোচনায় জয় ভদ্র

১৯৬৩ সালে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন এনগুগি। সে-বছর 'স্বাধীনতা' লাভ করে কেনিয়া। ততদিনে আচেবে'র মতো মুগোর অন্তর্দৃষ্টি তিনিও পেয়েছিলেন। 
 

সদ্য কৈশোর পেরোনো ছেলেটি তখন ম্যাকারের বিশ্ববিদ্যালয়ের ২য় বর্ষের ছাত্র। মাত্র বছর প্রায় দুয়েক আগেই পড়ে ছেলেছিল কেনিয়ার অন্যতম মহান লেখকের প্রথম উপন্যাস "থিংস ফল অ্যাপার্ট"। সময়টা ১৯৬১। স্থান উগান্ডার কাম্পালা শহর। ছেলেটি ছুটে গিয়েছিল সেই মহান লেখকের কাছে, এক নিশ্বাসে কথাগুলো বলেছিল ছেলেটি-- 'মিস্টার আচেবের সঙ্গে দেখা করতে এসেছি, এক মিনিট কথা বলেই চলে যাব।' কিন্তু সেই এক মিনিট আর এক মিনিট থাকেনি; বেশ কিছু সময় অতিবাহিত হয়ে গিয়েছিল সেইদিন। আসলে ছেলেটি নিজের বিদ্যালয়ের সাহিত্য পত্রিকায় প্রকাশিত নিজেরই একটি গল্প নিয়ে তাঁর কাছে উপস্থিত হয়েছিল। গল্পটি পড়ে গভীর অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে সেই মহান লেখক ছেলেটির দিকে তাকিয়েছিলেন; জহুরী ঠিক রত্ন চিনে নিয়েছিলেন, কারণ এই গল্পটির মধ্যে তিনি দেখেছিলেন, তাঁর সমগ্র জীবনের দর্শন-- কেনিয়ার চেনা গল্প, যা আফ্রিকার মানুষরা শুনতে চায়-- ছেলেটির গল্পের মধ্যে তারই প্রতিচ্ছায়া দেখতে পেয়েছিলেন, বলেছিলেন, 'লেখা চালিয়ে যাও, তোমার মধ্যে সম্ভাবনা রয়েছে। আরও বেশি লেখ, নিজেদের কথা লেখ, দেখবে গোটা বিশ্ব একদিন তোমার লেখা পড়বে।' বলাই বাহুল্য, পাঠকের নাম কেনিয়ার প্রবাদপ্রতিম সাহিত্যিক চিনুয়া আচেবে। চিনুয়া যেন এখানে কালো মানুষদের প্রাচীন ভবিষ্যৎদ্রষ্টা জ্ঞানী মুগো ওয়া কিরিবো'র জন্মান্তর রূপ, যে মুগো সাদা ঔপনিবেশিকদের আসার বহু আগেই বলেছিল-- 'প্রজাপতির মতো পোশাক পরা মানুষেরা আসবে এদেশে।' ছেলেটি অর্থাৎ সেই গল্পের যিনি স্রষ্ঠা সত্যিই একদিন আচেবের যোগ্য উত্তরসূরি হয়েছিলেন, হয়ে উঠেছিলেন সমগ্র কেনিয়া-সহ গোটা আফ্রিকার অবিসংবাদী লেখক। নাম: এনগুগি ওয়া থিয়োঙ্গো। 

Latest Videos

১৯৬৩ সালে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন এনগুগি। সে-বছর 'স্বাধীনতা' লাভ করে কেনিয়া। ততদিনে আচেবে'র মতো মুগোর অন্তর্দৃষ্টি তিনিও পেয়েছিলেন। কেনিয়া বা সমগ্র আফ্রিকার কালো মানুষদের প্রতি সাদা ব্রিটিশদের ঘৃণ্যতম হিংসা আর ক্রীতদাসের শৃংখলে বেঁধে রাখার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ আর আচেবে'র উপন্যাস যেন একই সমার্থক হয়ে উঠেছিল গুগির কাছে।  স্বজাতির পরম্পরাগত আধিভৌতিক জ্ঞান, লোকবিশ্বাস এবং তার থেকে গড়ে ওঠা সাংস্কৃতিক দর্শনবোধ, যদিও তা সাদাদের থেকে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র-- কালো মানুষদের সেই স্বাতন্ত্র্যতা গভীর মমতায় দেখেছিলেন এনগুগি। সাদাদের বিরুদ্ধে বুকের ভেতরটা দাউদাউ করে জ্বললেও আদবে সদ্য কৈশোর উত্তীর্ণ গুগলি ছিলেন মুখচোরা স্বভাবের; তাই আচেবের সঙ্গে সাক্ষাতের সময় বলে উঠতে পারেননি-- ইতিমধ্যেই সে একটা নতুন উপন্যাসে হাত দিয়ে ফেলেছে। নাম: "দ্য রিভার বিটুইন" অর্থাৎ অন্তর্বর্তী নদী।


দ্য রিভার বিটুইন

ইংরেজিতে রচিত আফ্রিকার বেশিরভাগ সাহিত্যের মতোই এনগুগির "দ্য রিভার বিটুইন" (১৯৮৬) উপন্যাসটিতে ঔপনিবেশিকতার বিষয়টি নিখুঁতভাবে চিত্রিত হয়েছে। আচেবে'র উপন্যাস "থিংস ফল অ্যাপার্ট"-এর মতোই এখানে ঔপনিবেশিক হস্তক্ষেপের সময়গুলি উপন্যাসের ক্যানভাসে ভেসে উঠেছে, সরাসরি আঘাত হানা হয়েছে ইউরোপীয় মিশনারি কর্মকাণ্ডকে, যাদের দ্বারা প্রত্যাখ্যাত হয়েছে কেনিয়ার আদিবাসীদের পরম্পরাগত সনাতন কৌমজীবনধারা ও তাদের প্রাচীন লোকবিশ্বাসকে । এক অর্থে ১৯২০-র দশকে কেনিয়ার মানুষদের সঙ্গে ঔপনিবেশিক সাদাদের সংস্কৃতির চরম দ্বন্দ্বটির এক জীবন্ত দলিল হয়ে আছে এই উপন্যাসটি। উপন্যাসের পুরো সময়কালই লেখকের যৌবনের ঔপনিবেশিক সময়ের সঙ্গে সম্পৃক্ত, যেখানে তিনি প্রত্যক্ষ করেছেন উপনিবেশ সংযাত পরিস্থিতির চাপে কিভাবে কৌমগোষ্ঠীর নিজেদের মধ্যে মতাদর্শগত বিভাজন ও পারস্পরিক শত্রুতায় জড়িয়ে পড়েছে। এনগুগি নিজেই তাঁর বহু প্রাচীন কৌমসংস্কৃতি ও লোকবিশ্বাস এবং ঔপনিবেশিক মতাদর্শের মধ্যবর্তী অবস্থানে আটকে পড়েছিলেন (কারণ তাঁর কিকুয়ু গোষ্ঠীর পরিবার তো খ্রিস্টধর্মেই দীক্ষিত ছিল।), যেটা তিনি তাঁর এই উপন্যাসের নায়ক ওয়াইয়াকি চরিত্রের মধ্যে দিয়েই তা প্রতিবিম্বিত করেছেন। তাই জীবনের প্রথম শুরু করা উপন্যাসের মধ্যে লেখক তাঁর প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা লব্ধ ব্রিটিশ উপনিবেশের অধীনে থাকা তাঁর দেশের কেনিয়ার রাষ্ট্রের হিংসার অভিমুখ-সহ আদিবাসীগোষ্ঠীর সামাজিক অবস্থানকেই নিখুঁতভাবে বর্ণনা করেছেন, আর তা করতে গিয়ে আদিবাসীদের সত্যকার স্বাধীনতা ও মুক্তির উপায় হিসেবে নিজের অবস্থানকে স্পষ্ট করেছেন উপন্যাসের নায়ক ওয়াইয়াকি চরিত্রের মধ্যে দিয়ে। বিশ্বের সমগ্র পাঠকের কাছে ওয়াইয়াকি তার সচেতন বোধ ও দৃঢ় সংকল্পকে সোচ্চার কণ্ঠে জানিয়েছে, জন্ম দিয়েছে শৃঙ্খল ও পরাধীনতার কবল থেকে উত্তরণের প্রকৃত মুক্তির সার্বজনীন ভ্রূণটিকে; তাই শত প্রতিকূলতার মধ্যেও ওয়াইয়াকি সিদ্ধান্তে অবিচল থাকে : 'সাদা লোকেদের সবটাই খারাপ নয়। এমনকি তাদের ধর্মের মূল বক্তব্যও মন্দ নয়-- তাতে কিছু ভালো, কিছু সত্য রয়েছে। এর থেকে যা নোংরা তা ছেঁকে ফেললেই তো শাশ্বত সত্তা পড়ে থাকে। এই শাশ্বত সত্যের সঙ্গে ঐতিহ্যের মিলন ঘটাতেই হবে। মানুষের ঐতিহ্য রাতারাতি মুছে ফেলা সম্ভব নয়।' ওয়াইয়াকি দৃঢ় কন্ঠে জানিয়েছে, 'বিদ্যালয়, বিদ্যালয় চাই... সাদা লোকেরা যা জানে আমাদেরও তা জানতেই হবে।'
উল্লেখ্য, ওয়াইয়াকিকে নিয়ে কালোদের জীবনধারা ও অন্যান্য চরিত্রদের উপস্থাপনা গিয়ুকু এবং ইউরোপীয় সংস্কৃতি উভয়ের উপাদানকে একত্রিত করেই হেনিয়া নদী বয়ে চলেছে কালো মানুষদের অন্তরাত্মা হয়ে-- যেখানে স্পষ্ট হয়ে ধরা দেয় দখলদার বহিরাগত সাদাদের চাপিয়ে দেওয়া সভ্যতা ও বিশ্বাসের পিঞ্জরের মধ্যে আটকে থাকা কালো মানুষদের পরস্পরবিরোধী আচরণ।

আদিবাসীদের মধ্যেকার দ্বন্দ্ব

উপন্যাসের শুরুই হয় : 'টিলা দুটো শুয়ে থাকে পাশাপাশি। ওদের একটা নাম কামেনো, অন্যটা মাকুয়ু। তাদের মাঝখানে একটা উপত্যকা, তাকে বলা হয় জীবন উপত্যকা। কামেনো ও মাকুয়ুর পিছনে আরও অনেক টিলা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে। ওগুলো একসাথে দেখলে মনে হয় অনেকগুলো ঘুমন্ত সিংহ। যেন তাদের স্রষ্টা ঘুম পাড়িয়ে রেখেছে। ওরা জাগে না কখনও।'
   এই জীবন উপত্যকা দিয়েই বয়ে গেছে হেনিয়া। এ নদী কখনো শুকায় না। বলা যায়, কামেনো ও মাকুয়ুর প্রাণশক্তি এই হেনিয়া। লোকবিশ্বাস এ-দেশের আদি পিতা-মাতা গিয়ুকু ও মুম্বি, মুকুরুয়ে ওয়ে গথাঙ্গা যাওয়ার পথে মাকুয়ুতে কিছুকাল বিশ্রাম নিয়েছিলেন। সেই অর্থে সেরার সম্মান পাওয়া উচিত মাকুয়ুর। কিন্তু কেউ কেউ বলে কামেনোর দক্ষিণে তাদের পায়ের স্পর্শে একদিন মাথা তুলেছিল পবিত্র গুল্ম-- লোকেরা আজও সেখানে পুজো দেয়। তাছাড়া অন্যান্য টিলার চাইতে কামেনোতে সবচেয়ে বেশি দেশনায়ক আর নেতারা জন্ম নিয়েছে। প্রাচীন মহান ভবিষ্যৎদ্রষ্টা জ্ঞানী মুগো ওয়া কিরিবো'র জন্ম এখানেই।
   দুই টিলার এই ঐতিহ্যগত পরম্পরাই একদিন এক ঐতিহাসিক সময়ে পরস্পরকে স্বতন্ত্র হিসেবে দেখা দিয়েছে। উপন্যাস যত এগোতে থাকে আদিবাসীদের সাথে ঔপনিবেশিকদের যে মূল দ্বন্দ্ব সেটি গৌণ হয়ে পড়ে, অপ্রধাণ দ্বন্দ্বটি মূল দ্বন্দ্বের জায়গা নেয়-- ঔপনিবেশীকরণের দ্বারা নির্মিত আদিবাসীদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া সাদাদের সাংস্কৃতিক অভিঘাতের ফলে আদিবাসীদের গোষ্ঠীজীবনের মধ্যে ফাটল ও বিভাজন এবং পারস্পরিক সংঘাতই এখানে বড়ো হয়ে দেখা দিয়েছে। মাকুয়ুর কিছু বাসিন্দা ঔপনিবেশিকদের প্রভাবে খ্রিস্টান ধর্মে দীক্ষিত হয়েছে-- কারণ শ্বেতাঙ্গ ব্রিটিশরা চেয়েছিল দেশীয় খ্রিস্টানদের মাধ্যমে কেনিয়ার সমগ্র কালো মানুষদের লোকবিশ্বাস, জীবনবোধ এবং তাদের পরম্পরাগত সংস্কারকে (যা তারা মনে করে 'কুসংস্কার') সমূলে উৎপাটিত করে সাদাদের জীবনবোধ ও সংস্কৃতিতে বিশ্বাস করানো। (স্মর্তব্য, মেকলে'র ১৮৩৫ সালে তাঁর ঔপনিবেশিত ভারতের শিক্ষাব্যবস্থা সম্পর্কিত নীতিটি, যা ব্রিটিশরা তাদের সব উপনিবেশগুলোর জন্যই প্রয়োগ করেছিল।) অন্যদিকে কামেনোর বাসিন্দারা তাদের ঐতিহ্যগত পরম্পরাকে আঁকড়ে ধরে ছিল।  মাকুয়ুর বাসিন্দা জোশুয়া একজন কট্টর খ্রিস্টান, যে নিজের গোষ্ঠীর মানুষদের পরম্পরাগত ঐতিহ্যকে ঘৃণার চোখে দেখে তাই জোশুয়া হয়ে ওঠে সাদাদের বিশ্বস্ত প্রতিনিধি। মাকুয়ুতে নির্মিত গির্জা হয়ে উঠল জোশুয়ার নেতৃত্বে ধর্মান্তরকরণের কেন্দ্রস্থল।
 উল্টোদিকে কামেনোতে ওয়াইয়াকি'র বাবা চেগে ছিল মুগো'র উত্তরসূরী, যে ভূত-ভবিষ্যৎ দেখতে পেত,  মে তার অতীন্দ্রিয় জ্ঞান ছেলেকে দিয়ে গিয়েছিল, বলেছিল, 'মিশনে যাও। সাদা মানুষদের সব জ্ঞান, ওদের সব রহস্য শিখে নাও। কিন্তু ওদের দোষগুলো অনুসরণ কোরো না। তোমার দেশবাসী ও প্রাচীন অধিকারের প্রতি সৎ থেকো।' বাবার আদর্শে লালিত ওয়াইয়াকি তাই চেয়েছিল সাদাদের শিক্ষার শুধুমাত্র ভালোটা নিয়ে গোষ্ঠীর সমগ্র মানুষকে অথবা সমগ্র কৌমসমাজকে একসূত্রে গাঁথা; কারণ সাদারা নিজেদের নির্মিত শিক্ষার জোরে-- বুদ্ধির চাতুরতা ও ছলনায় দুর্বলকে অত্যাচার ও শোষণ করে চলেছে যুগের পর যুগ; তারা তো 'অশিক্ষিত' 'বন্য' কালো মানুষদের মানুষ বলেই জ্ঞান করে না! কালোদেরকে উদয়াস্ত জোরপূর্বক খাটানো যায়, জোরজবস্তি তাদেরকে নিজেদের ভিটে থেকে উচ্ছেদ করা যায়, বা বলপূর্বক অন্যায় খাজনা আদায় করা যায় তাদের কাছ থেকে, অথবা জাহাজে বোঝাই করে ক্রীতদাস হিসেবে বেছে দেওয়া হয় দেশ দেশান্তরে। তাই ওয়াইয়াকি চেয়েছিল সাদাদের ষড়যন্ত্র ও অত্যাচারের হাত থেকে বাঁচার একমাত্র অস্ত্রই হলো "শিক্ষা"। শুধুমাত্র প্রাচীন জ্ঞান ও পরম্পরাগত ঐতিহ্য বা সংস্কার দিয়ে আদিবাসীরা আধুনিক বিশ্বের জ্ঞানলব্ধ কূটকৌশলী কুচক্রী বহিরাগত শাসকদের বিরুদ্ধে এঁটে উঠতে পারবে না; সাদাদের দখল করে নেওয়া কেনিয়ার ভূমিপুত্ররা মুক্তি পাবে না। তাই সাদাদের (জ্ঞানের) অস্ত্র দিয়েই সাদাদেরকে বধ করতে হবে।
সারা উপন্যাসটির আখ্যান কেনিয়ার এক বিশেষ অঞ্চলের পাহাড় ও নদী দিয়ে ঘেরা আপাত শান্ত নৈসর্গিক পটভূমিকায় উপজাতিদের মধ্যেকার দ্বন্দ্বকেই প্রকট করে তুলেছে, আর এই দ্বন্দ্বের মধ্যে নিজের সত্যে অবিচল থেকে ওয়াইয়াকি টিলার মানুষদের একসূত্রে বাঁধতে চেয়েছে, মা হেনিয়া নদী বহু প্রাচীনকাল থেকে আজও করে চলেছে। সে শিক্ষিত যুবকদের দেশপ্রেমের আদর্শে উজ্জীবিত করে স্বজাতির আত্মমর্যাদাকে ফিরিয়ে আনতে চেয়েছে, আর নবীন প্রজন্মের চোখে স্বপ্ন যুগিয়েছে দাসত্ব বা পরাধীনতার শৃঙ্খল অথবা সাদাদের গ্রাস থেকে মুক্ত হতে। তাই জন্যই ওয়াইয়াকি বেছে নিয়েছে শিক্ষাকে-- সাদাদের এই 'জাদুশক্তি'কে, যা একদিন টিলার কালো মানুষেরা রপ্ত করে ঔপনিবেশের কবল থেকে নিজেদের মুক্ত করবে, সাদাদের চোখের উপর চোখ রেখে কথা বলতে পারবে; উল্টে তারাই একদিন সাদাদের বলবে-- 'দূর হঠো', অথবা ওয়াইয়াকির মতো তারাও আন্তরিক হয়ে উঠবে, বলবে, 'আমাদের একজোট হয়ে দাঁড়াতেই হবে। আমাদের প্রাচীন দ্বন্দ্ব শেষ করতেই হবে।'


নিজের টিলায় ওয়াইয়াকি তাই স্কুল খুলেছে; অন্যান্য টিলায়ও স্কুল খোলার উদ্যোগ নিয়েছে সে। নিজের ও আশেপাশের টিলার আবালবৃদ্ধবনিতা সবাই তাকে মান্য করে, তাকে "গুরুমশাই" বলে ডাকে। ওয়াইয়াকি নিজেকে মনে করত সেই কালোদের শেষ 'মসিহা', কারণ তার বাবা তাকে বলেছিল ভবিষ্যৎদ্রষ্টা মুগোর রক্ত বইছে তার শরীরে, আর ওয়াইয়াকি হল তাদেরই শেষ বংশধর।
ওয়াইয়াকির জনপ্রিয়তা তার আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে জোশুয়ার মেয়ে ন্যয়মবুরা ওয়াইয়্যাকি জীবনের সাথে সম্পৃক্ত হতে চায়। কিন্তু কট্টর খ্রিস্টান জোশুয়া ওয়াইয়াকির মতোন যারা উপজাতির নিজস্ব পরম্পরায় বিশ্বাসী তাদেরকে নিছক সে ঘৃণার চোখেই দেখে! মূলত ন্যয়মবুরাকে কেন্দ্র করেই উপন্যাসে প্রকট হয়েছে দরিদ্র উপজাতিদের মধ্যেকার আদিম সংকীর্ণতা, হিংসা অথবা ঈর্ষা-- গৌণ হয়ে যায় বহিরাগত সাদাদের বিরুদ্ধে আদিবাসী কৌমজীবনের প্রধান সংগ্রামটি, দুর্বল-ভঙ্গুর হয়ে পড়ে চরম বিপদের সময়ে আদিবাসী গোষ্ঠীজীবনের পারস্পরিক বিশ্বাসের সুদৃঢ় প্রাচীরটি। একসময়ের জোশুয়ার চেলা কাবোন্যি পরবর্তীতে নিছকই ঔপনিবেশিক শাসন ও শোষণের মূল কারণটির  ঊর্ধ্বে উঠে ছলে-বলে-কৌশলে কৌমগোষ্ঠীর জীবনের ওপর দখলদারি বজায় রাখতে চায়-- এই প্রশ্নে কাবোন্যি আজ জোশুয়ার শত্রু। কাবোন্যির শত্রু ওয়াইয়াকি'ও; কারণ ওয়াইয়াকি'র জনপ্রিয়তা তার কাছে অস্তিত্ব সংকটের প্রশ্ন-- কাবোন্যির তাই পথের কাঁটাকে চিরতরে উপড়ে ফেলার বাসনা! এক অর্থে পরস্পর আপাত শত্রু হলেও জোশুয়া আর কাবোন্যি একই গোত্রের; দু'জনেরই শুধুমাত্র একটাই লক্ষ্য-- নিজের কৌমগোষ্ঠীর জীবনকে নিয়ন্ত্রণ করা। এই দুইজনের কাছেই ওয়াইয়াকৃতি'র মানবধর্ম জীবনাদর্শ নিষ্পেষিত  হয়ছে।যে-টিলার জনগণ তাকে 'মসিহা' করে তুলেছিল, কাবোন্যি'র ঘৃণ্য আত্মঘাতী রাজনৈতিক চক্রান্তে সেই জনগণই ওয়াইয়াকি ও ন্যয়বুরা'র ব্যাপারে শেষপর্যন্ত নিরপেক্ষ থেকে যায়, উপজাতিদের রাজনৈতিক সংগঠন "কিয়ামা"র উপর বিচারের ভার দিয়ে তারা সব কিছুকে হাত ধুয়ে ঝেড়ে ফেলতে চায়।
শেষপর্যন্ত আমরা পাঠকরা কেউই জানতে পারি না ওয়াইয়াকি ও ন্যয়মবুরা'র নিয়তিতে ঠিক কি লেখা আছে। তবে আমরা ধরে নিতে পারি ওয়াইয়াকি হল মুগো ওয়া কিরিবো'র শেষ বংশধর, যে মুগো ভবিষ্যৎবাণী করেছিল-- 'প্রজাপতির মতো পোশাকের লোকেরা আসবে এদেশে। কিন্তু সবাই সেদিন তাকে প্রত্যাখ্যান করেছিল। আর যখন সাদা মানুষেরা এল, কামেনো ও মাকুয়ুর মধ্যে দাঁড়ালো ঈর্ষা।'
এনগুগি তার এই উপন্যাস শুরু করেছিলেন কেনিয়ার ঔপনিবেশিক সময়ের পর্বে, কিন্তু বই আকারে প্রকাশ পায় কেনিয়ার 'স্বাধীনতা'র উত্তর কালে (১৯৮৬)-- তা বলা যায় এক উপনিবেশিক পর্বে, যে সময় এখন হেনিয়া নদীর মতো বয়ে চলেছে। ওয়াইয়াকি'র সম্ভাব্য পরিণতি কি আরও কোনোভাবে আন্দাজ করা যায়? তার বেশকিছু হদিস পাওয়া যায় এনগুগি'র জীবন-ইতিহাস চর্চায়। ১৯৭৭ সাল। নিজের লেখা নাটক "নগাহিকা এনদিন্দা" ( I will marry when I want) মঞ্চস্থ হয়। দেশীয় শাসকের ক্ষমতাকে প্রশ্ন করেছিলেন। উত্তর পেয়েও গিয়েছিলেন যথারীতি। প্রায় বছর খানেকের জেল... এরপর ২২ বছর বিদেশে নির্বাসন। দেশে ফিরে আসার দিনই সঙ্গিনী স্ত্রীর ওপর নির্যাতন দেখতে হয় চোখের সামনে, অথবা নিছক কালো চামড়ার মানুষ হওয়ার কারণে হোটেল থেকে বেশ কয়েকবার ঘাড় ধাক্কা দিয়ে আর করে দেয়া হয় এই মহান সাহিত্যিককে। কেনিয়া তখন 'স্বাধীন'! আর এসব ঘটবেই না কেন নির্বিকারে নির্দ্বিধায়? 'তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর কাছে স্বাধীনতা মানে প্রহসন, বিদেশি শাসকের হাত থেকে দেশের শাসকদের হাতে রাষ্ট্রের ক্ষমতা হস্তান্তর মাত্র। এনগুগি দেখলেন শাসকদের চামড়ার রঙ বদলালেও তাদের চরিত্র বদলাইনি।'


বঙ্গে বয়ে যায় অন্তর্বর্তী নদী

এনগুগি'র "দ্য রিভার বিটুইন" বাংলায় ভাষান্তর করেছেন শমরিতা চক্রবর্তী। নামকরণ করেছেন: "অন্তর্বর্তী নদী"। অনুবাদ যদি কোনও দেশের কোনও নির্দিষ্ট অঞ্চলের ভাষায় অনূদিত হয় এবং তা যদি পাঠকের কাছে শিল্পসুষমায় উত্তীর্ণ হয়, তাহলে ধরে নিতে হবে সেই অনুবাদ সাহিত্য সেই দেশের সেই অঞ্চলের ভাষার একান্তই মৌলিক সাহিত্য। সেইদিক থেকে সম্পূর্ণ সফল শময়িতা। সফল এই কারণেই, ইংরেজি থেকে অনূদিত উপন্যাসটির বিদেশি চরিত্রগুলোর নির্মাণ ও তাদের মুখের ভাষার মনস্তাত্ত্বিক ব্যবহার হতদরিদ্র গ্রামীণ বাংলার খেটে-খাওয়া মানুষের স্বপ্ন ও তার মুখের ভাষার সাথে একাকার হয়ে গেছে। অনুবাদের ভাষা হয়ে উঠেছে তাই সহজ-স্বাভাবিক বাংলার নিজস্বতায়। ওয়াইয়াকি, জোশুয়া, ন্যয়মবুরা, কিংবা মুথোনি চরিত্রগুলো শুধুমাত্র কেনিয়াকে প্রতিনিধিত্ব করেনি-- '৪৭-এ ক্ষমতা হস্তান্তরের পরবর্তী উত্তর-উপনিবেশবাদ বা নয়া উদারীকরণের পর্বের (এক অর্থে বলা যায় নয়া উপনিবেশবাদ-ও) বাংলাকেও যেন প্রতিনিধিত্ব করেছে। ওয়াইয়াকি'র স্বপ্ন বা স্বপ্নভঙ্গ অথবা কাবোন্যি'রর মতো আকাশ-সমান আলাদীনের দৈত্য হয়ে ওঠা '৪৭ পরবর্তী দেশীয় শাসকের বদন্যতায় এ আমরা অহরহ প্রত্যক্ষ করে চলেছি। সুতরাং "দ্য রিভার বিটুইন" যদি তৃতীয় বিশ্বের আফ্রিকার বা কেনিয়ার নিজস্ব সাহিত্য হয়, তাহলে "অন্তর্বর্তী নদী" একান্তই এই বঙ্গের। তাই ওয়াইয়াকিরা হয়ে উঠেছে সমগ্র বঙ্গেরই কোনো চরিত্র। অনুবাদের সার্থকতা এখানেই আশাকরি শময়িতার কাছ থেকে পাঠক এরকম ভালো কাজ আরো অনেক পাবে।
এই অনুবাদগ্রন্থটির দুর্বল দিক হল-- বেশ কয়েক পাতায় মুদ্রণ বিভ্রাট ঘটেছে। পরবর্তী সংস্করণে আশাকরি লেখক সেই ভুল শুধরে নেবেন। প্রচ্ছদে রাজু চক্রবর্তীর কাজ ভালো লাগে।

সংকলনা- জয় ভদ্র, "হরপ্পা", "হাজার শতাব্দীর রূপকথা অথবা রাজনৈতিক বিষণ্ণতা", "ইডিকেস"-এর মতো বইয়ের লেখক তিনি, নয়ের দশকের শেষ লগ্ন থেকে লেখালেখি শুরু। "হরপ্পা" অনূদিত হয়েছে হিন্দি ভাষায়। এছাড়াও তার ছোটগল্পগুলো একসময় হিন্দি পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। ছিলেন এক বিশেষ পত্রিকার কার্যকরী সম্পাদক। একটা সময়  মূলত সাংবাদিকতার সঙ্গে সঙ্গে চালিয়ে গিয়েছিলেন সাহিত্যকর্ম। এই মুহূর্তে পুরোপুরি সাহিত্যেই মনোনিবেশ করেছেন। গল্প, উপন্যাস যেমন তাঁর অবাধ বিচরণ ক্ষেত্র তেমনি পুস্তক সমালোচনা এবং নাট্য-সমালোচক হিসাবেও সমাদৃত হয়েছেন।
 

Share this article
click me!

Latest Videos

বাংলাদেশে এবার খ্রিষ্টানদের বড়দিনের অনুষ্ঠানে হামলা, দেখুন এই ইস্যতে কী বললেন Suvendu Adhikari
Narendra Modi : বড়দিনের অনুষ্ঠানে মাতলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী, সকলকে জানালেন শুভেচ্ছা
২৬-এ Mamata Banerjee-কে বিদায়! মমতাকে প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বানানোর শপথ Suvendu Adhikari-র
Suvendu Adhikari Live : শতবর্ষে অটল বিহারী বাজপেয়ী, শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন শুভেন্দু অধিকারীর
Daily Horoscope: ২৬ ডিসেম্বর বৃহস্পতিবার এই ব্যক্তিদের দিনটি ভালো যাবে, জেনে নিন আজকের রাশিফল