কোজাগরী পূর্ণিমায় লক্ষ্মীর পাশাপাশি পুজিত হন সরস্বতী ও নারায়ণও, বাংলার এই গ্রামে পুজো হয়ে আসছে এমনভাবেই

  • প্রতি বছর কোজাগরী লক্ষী পুজোর দিন ঘরে ঘরে পুজিত হন দেবী লক্ষী
  • ঝাড়গ্রামের হাড়দা গ্রামে কোজাগরী পূর্ণিমায় লক্ষ্মী পাশাপাশি পুজো হয় দেবী সরস্বতীরও
  • লক্ষী সরস্বতীর সঙ্গেই সেখানে পুজো হয় নারায়ণ ঠাকুরেরও
  • এবছরও তার অন্যথা হচ্ছে না সেখানে, পুজোয় মেতেছেন সেখানকার গ্রামবাসীরা

Tapan Malik | Published : Oct 30, 2020 5:36 AM IST / Updated: Oct 30 2020, 11:55 AM IST

এই করোনাকালেও বাঙালির ঘরে ঘরে বন্দিত হবেন সম্পদের দেবী লক্ষ্মী। যুগ-যুগান্ত ধরে বাংলায় কোজাগরী পূর্ণিমায় তাঁর আরাধনা চলছে। কেউ বাড়িতে লক্ষী প্রতিমার পুজো করেন, কেউ সরা, কেউ আবার কলা বউ পুজো করেন। কিন্তু ঝাড়গ্রামের বিনপুর এলাকার হাড়দা গ্রামে কোজাগরী পূর্ণিমায় একই সঙ্গে পুজো পেয়ে আসছেন সম্পদ ও বিদ্যার দেবী লক্ষ্মী ও সরস্বতী। কেবল দুই বোন নন, পুজো পান নারায়ণ। তাদের পাশে থাকেন চার জন সখী। এই রীতি হাড়দা গ্রানের মণ্ডলদের পারিবারিক হলেও বেশ কয়েক বছর ধরে সেটা হয়ে গিয়েছে গ্রামের সকলের পুজো। পুজোয় অংশ নেন আশেপাশের গ্রামের মানুষও। তবে পুজোর সমস্ত খরচ বহন করেন মণ্ডলর পরিবার৷ লক্ষ্মী পুজোকে কেন্দ্র করে পাঁচদিনের মেলা বসে।

একইসঙ্গে লক্ষ্মী ও সরস্বতী পুজো ঘিরে এ গ্রামে গল্প চালু আছে। প্রায় দু’শো বছর আগের মণ্ডলদের অবস্থা ছিল খুবই খারাপ। চাষাবাদ করে তাদের কোনওক্রমে দিন গুজরান হত। জাতপাতের প্রাচীন ধারণা অনুসারে মন্ডলরা ছিল নীচু জাত। গ্রামের তথাকথিত উঁচু জাতের লোকেদের বাড়িতে মন্ডলদের প্রবেশ নিষিদ্ধ ছিল। তাঁরা বাড়িতে এলে গোবর জল ছেটানো হত। মেদিনীপুরের ঝাড়্গ্রাম অঞ্চল তখন ছিল খরাপ্রবণ এলাকা। চাষ নিয়ে চাষিদের ভাবনা লেগেই থাকত। মন্ডল পরিবারের কর্তা সুরেন্দ্রনাথ মণ্ডল মনে মনে ঠিক করলেন মা লক্ষীর পুজো করবেন। তারপরই মন্ডলদের এক গুরুদের সুরেন্দ্রনাথ মন্ডল কে পুজো করার অনুমতি দেন। কথিত এক সময় হাড়দা গ্রামের শুঁড়ি সম্প্রদায়ের মানুষরা গ্রামের ‘মোড়ল’ হিসেবে পরিচিত ছিলেন। স্থানীয়রা ওই পরিবারগুলিকে ‘মণ্ডল-বাকুল’ বলতেন। গ্রামের বাসিন্দা অক্রুর মণ্ডল স্বপ্নাদেশ পেয়েছিলেন বিদ্যা ও সম্পদের দুই রূপকে একসঙ্গে পুজো করতে। তারপর থেকেই এই পুজোর শুরু।

এই অঞ্চলের ইতিহাস ঘেঁটে পাওয়া যায়, চৈতন্যদেব পুরী থেকে নবদ্বীপ ফেরার সময় ঝাড়গ্রাম এলাকায় অন্ত্যজ মানুষদের মধ্যে বৈষ্ণব ধর্ম প্রচার করেছিলেন। বৈষ্ণব ধর্মাবলম্বী মণ্ডলরা পীতবসনধারী চৈতন্যরূপী নারায়ণের সেবা করেন। যে কারণে একচালার প্রতিমার ওপর নারায়ণ এখানে চৈতন্যরূপী। যে সময় হাড়দা গ্রামে লক্ষ্মী পুজো শুরু হয়েছিল তখন প্রায় ৬০টি মণ্ডল পরিবার বাস করত। এখন সেই পরিবারের সংখ্যা ৪০০। তবে হাড়দা গ্রামের সবার পদবি মণ্ডল নয়। অন্য ধরনের পদবিও রয়েছে৷ বহুবছর ধরে দুর্গা পুজোর বদলে লক্ষ্মীপুজো হাড়দা গ্রামে শারদোত্‍সবের চেহারা নেয়। শুধু প্রতিমাই ভিন্ন ধরণের নয়, পুজোর প্রসাদেও আছে বিশেষত্ব। লক্ষ্মীকে দেওয়া হয় বিশেষ একপ্রকার লাড্ডু। আরও একটি বৈশিষ্ট্য হল লক্ষ্মীর নৈবেদ্যে কোনও কাটা ফল দেওয়া হয় না, সব ফল থাকে গোটা। ক্ষিরপায়ের বাবরশা, পাঁশকুড়ার চপ, শক্তিগড়ের ল্যাংচা যেমন বিখ্যাত, ঠিক তেমনই হাড়দার লক্ষী পুজোর অন্যতম আকর্ষন অমৃতি বা জিলিপি। লক্ষ্মী পুজো ঘিরে পাঁচ দিনের যে মেলা বসে সেখানে লাড্ডু বিক্রি হয়। পাঁচ দিনের মেলাতে ১০০ কুইন্টালের ওপর জিলিপি বিক্রি হয়। নীলাম হয় জিলিপির দোকান, দামও আগে থেকে বেঁধে দেওয়া হয়। বহু দূর থেকে মেলায় আসেন মানুষ। জিলিপির আকারও হয় বিশাল। কোজাগরী পূর্ণিমায় লক্ষীর পাশে নারায়ণ রেখে সম্পদের দেবীর আরাধনা হয় রায়গঞ্জের টেনহরি গ্রামে। এখানেও দুর্গাপুজোয় তেমন মাতামাতি থাকে না।

আরও পড়ুন: কোজাগরী লক্ষী পুজোর আগে বাজার আগুন, সব উপেক্ষা করেই চলছে পুজোর কেনাকাটা

আরও পড়ুন: হাতে সব সময় থাকবে টাকা, লক্ষ্মী পুজোয় পালন করুন এই নিয়মগুলি

গ্রামের সবাই অপেক্ষা করে থাকেন লক্ষ্মীপুজোর জন্য। দুর্গা পুজো নয় কোজাগরী লক্ষ্মীপুজোতেই গ্রামবাসীরা নতুন জামাকাপড় পড়েন। বিগত বেশ কয়েক বছর ধরে রায়গঞ্জের টেনহরি গ্রামের লক্ষ্মী পতসব। এখানকার মানুষের সব থেকে বড় উৎসব। হেমন্তের শুরুতে মাঠ জুড়ে যে সোনার ফসল ফলে তা লক্ষ্মীর আরাধনারই ফল। গ্রামের শ্রীবৃদ্ধিও ঘটে লক্ষীর পুজোতে। এই বিশ্বাস নিয়ে গত ষাট বছর ধরে এই গ্রামের মানুষ মহাসমারোহে লক্ষ্মী পুজো করে আসছে। দুর্গা পুজো এখানে হয় না বললেই চলে। গ্রামবাসীদের যত ভাবনা লক্ষ্মীপুজো ঘিরে। টেনহরি গ্রামে কোজাগরী লক্ষ্মীর বিশেষত্ব হল লক্ষ্মীর পাশে থাকেন নারায়ণ। আর তাদের ঘিরে থাকে দুই সখী জয়া ও বিজয়া। লক্ষ্মীর সামনে থাকে গরুর পাখি। পুজো উপলক্ষে বিরাট মেলা বসে। কথিত বহু বছর আগে পূর্ব বাংলা থেকে বেশ কিছু মানুষ এসে আশ্রয় নিয়েছিল টেনহরি গ্রামে। তখন ওই এলাকায় ভাল ফসল ফলত না। একবার লক্ষ্মীপুজো ধুমধুাম করে হয়। তারপরই শস্যশ্যামলা হয়ে ওঠে এলাকার জমি। সেই থেকে লক্ষ্মীই গ্রামবাসীদের প্রধান আরাধ্যা হয়ে যায়।

Share this article
click me!