মঠ মূলত চিনির তৈরি উঁচু শক্ত একটি মিষ্টি। সেটা মোমবাতি, ফুল, পাখি-সহ বিভিন্ন আকারের হয়। চুটিয়ে রঙ খেলার ফাঁকে মুখে চালান হয়ে হত এই মঠ ও ফুটকড়াই।
কয়েক বছর আগে পর্যন্ত দোলের (Dol Yatra) দিনে মিষ্টিমুখ (Bengali Sweet) মানেই তা অবশ্যই মঠ হতে হবে। সঙ্গে থাকত ফুটকড়াই ও তার সঙ্গে সাদা মুড়কি। অতীতে দোল উৎসবে (Dol Utsab) এত বেশি বাহ্যিক আড়ম্বর না থাকলেও দোল উৎসব ছিল আন্তরিকতায় ভরা। তখন দেবতার পায়ে 'আবির' দিয়ে পরিবারের সকল বয়স্কদের পায়ে আবির মাখিয়ে শুরু হত দোল খেলা। দু'দিন ধরেই চলত সেই দোল। আর রঙ খেলার মধ্যেই আত্মীয়-পরিজনদের মধ্যে গোলাপি, হলুদ, সাদা রঙের মঠ ও ফুটকড়াই খাওয়া চলত। এটাই ছিল সনাতনী বাঙালির দোল খেলা (Dol Khela)।
বিভিন্ন আকৃতির মঠ
মঠ মূলত চিনির তৈরি উঁচু শক্ত একটি মিষ্টি। সেটা মোমবাতি, ফুল, পাখি-সহ বিভিন্ন আকারের হয়। চুটিয়ে রঙ খেলার ফাঁকে মুখে চালান হয়ে হত এই মঠ ও ফুটকড়াই। একটি বড় থালায় প্রচুর মট সাজানো থাকত আর পাশে থাকত ফুটকড়াই। দোল খেলার সময়ে এগুলি ছিল আবশ্যিক।
আরও পড়ুন- রাত পোহালেই হোলি, রং খেলার আগে কীভাবে নেবেন ত্বকের বাড়তি যত্ন
মঠের ইতিহাস
মঠের ইতিহাস বেশ সুপ্রাচীন। দোল পূর্ণিমায় রাধামাধবের প্রসাদের থালায় বাতাসা কদমার মাঝখানে সাজানো মন্দিরের চূড়ার আকারের মিষ্টিটাই হল মঠ। যদিও এই মঠ মিষ্টান্ন বাঙালিয়ানার কৃষ্টি না হলেও বাঙালি একে আপন করে নিয়েছে নিজের সংস্কৃতিতে। মঠ মূলত পর্তুগিজ মিষ্টি। হুগলির ব্যান্ডেল চার্চে প্রথম এই মিষ্টি প্রভু যিশুর প্রসাদী থালায় পাওয়া যায়। পরে বাঙালি ময়রারা পরম স্নেহে মটকে বাঙালি বানিয়ে ফেলেছেন। তাকে গোলাপি, হলুদ, লাল নানান রঙে রাঙিয়ে দোলের আঙিনায় ছেড়ে দোলের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ করে ফেলেছেন।
মঠ
কীভাবে তৈরি হয় মঠ
চিনির কড়া পাক দিয়ে সেই সান্দ্র তরল কাঠের ছাঁচে জমিয়ে বা ফুটো পাত্রের ভিতর দিয়ে ফোঁটা ফোঁটা ফেলে এই মট প্রস্তুত করা হয়। এটি ৫-৬ সেন্টিমিটার উঁচু একটি শুকনো ও অত্যন্ত পরিচিত মিষ্টি। এই মঠ তৈরির এই ধারা আজও বর্তমান রেখেছেন হাওড়ার উনসানি শিউলি পাড়ার স্বপন মণ্ডল ও তাঁর পরিবার।
আরও পড়ুন- রঙের উৎসবে বিপদ থেকে সাবধান, চোখ বাঁচিয়ে দোল খেলতে এই পন্থা গুলি অবশ্যই জেনে রাখুন
তাঁরা নিজের বাড়িতে যত্নের সঙ্গে তৈরি করেন এই মঠ। বাপ-ঠাকুরদার এই ব্যবসাকে সম্বল করেই চলে স্বপনবাবুর সংসার। আগে দোলের প্রায় ১৫দিন আগে থেকে মঠ প্রস্তুতি শুরু হয়ে যেত। এখন ৭ দিন আগেই কাজ শুরু হয়। দোলের সময়ে এই মঠের চাহিদা থাকলেও সারাবছর তা থাকে না। অগত্যা সংসার চালাতে দুই ধরনের বাতাসা ও সাদা মুড়কি ভরসা। তবে এই বছরে সেভাবে চাহিদা নেই মঠের। সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের সুগারের ব্যাধির কারণে এই ধরণের মিষ্টি থেকে মুখ ফিরিয়েছেন অনেকেই। এখন শুধু পুজোর কাজেই ব্যবহার হয় এই মঠ। এমনটাই জানিয়েছেন মঠ প্রস্তুতকারী উনসানীর বাসিন্দা স্বপন মণ্ডল।
ফুটকড়াই
স্বপন বাবু বলেন, "অধিকাংশ কারীগরেরাই এখন অন্য পেশা বেছে নিয়েছেন। কারণ পর্যাপ্ত কাজ না থাকায় এছাড়া আর কোনও উপায় নেই। তাই কারিগর পাওয়াটাও দুঃসাধ্য হয়ে যাচ্ছে। দীর্ঘ ১৮ বছর এই কাজ করছি। চিনি, গুড় দিয়েই প্রধানত তৈরি হয় মঠ। তবে ৫ জন মিলে একশো কেজি বাতাসা তৈরি করতে ৬ ঘণ্টা সময় লাগে। কোভিডের আগে ব্যবসা ভালো চললেও কোভিডের পর থেকে ব্যবসা মন্দার দিকেই রয়েছে। আগে ব্যবসায় অনেক লাভ করলেও এখন সেই লাভ তলানিতে এসে ঠেকেছে।" তবু এদিক ওদিক মিলিয়ে সংসার চালান তাঁরা। পাশাপাশি এই ব্যবসায় যুক্ত এক শ্রমিক প্রকাশ মোখান বলেন, "এখন চাহিদা সেভাবে নেই। খরিদ্দারের সংখ্যাও অনেক কম। কোভিডের পর মানুষের হাতে সেভাবে টাকা নেই তাই বিক্রির পরিমাণও কমে গিয়েছে।"
আরও পড়ুন- রঙ খেলার আনন্দে বারোটা বাজতে পারে ত্বক ও চুলের, কীভাবে পাবেন রক্ষা, টিপস দিলেন শেহনাজ
দোলের দিন পুজো হোক বা আনন্দ করে রঙ খেলা। সবেতেই এই সব মিষ্টির জায়গা ছিল পাকা। এখন অবশ্য অনেকে জানেনও না এগুলোর কথা। অথবা স্বাস্থ্যের কথা ভেবে এসব খাওয়া হয় না। যাই হোক বছরের একটা দিনে এটাই ছিল এক সময়ের রীতি, আনন্দ। এখন সেই সব মঠ, ফুটকড়াই দেবতার প্রসাদ হয়ে কোনওক্রমে বেঁচে আছে। তাও ক্রমশ অনেক পরিবার থেকেই বিলুপ্তপ্রায়। তাই কোভিড পরিস্থিতি কেটে যাওয়ার পরে আবার আগের মতো চাহিদা বাড়বে কিনা এই অনিশ্চিত ভবিষ্যতের প্রশ্নের মুখে দাঁড়িয়ে আছে স্বপন মণ্ডল ও তাঁর পরিবার। যদিও আশা করেন পরিস্থিতি আবার স্বাভাবিক হোক। আবার এই ব্যবসাতে আগের মতো চাহিদা ফিরুক।