মৃত্যুর স্বাদ কেমন? এমন মানুষের কিছু বয়ান যা উঠে এসেছে গবেষণায়

মৃত্যু নিয়ে প্রায়শই নানা প্রশ্ন। এমন সব প্রশ্নের উৎপত্তি যে বর্তমান সময়ে তা নয়। শতকের পর শতক এই নিয়ে উত্তর খুঁজছে মানব সভ্যতা। কিন্তু, মৃত্যুর চরম সত্যটা আজও কেউ উদঘাটন করতে পারেনি। তবে, মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে আসা মানুষদের অভিজ্ঞতা বর্ণন সকলের যে কৌতুহলকে বাড়ায় তাতে সন্দেহ নেই। 

সালটা ২০১১। ইংল্যান্ডের সাউদাম্পটন জেনারেল হাসপাতাল। সাতান্ন বছরের এক লোককে হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়েছিল অতি গুরুতর অবস্থায়। পেশায় সমাজসেবী এই মানুষটি যাকে মিস্টার এ বলে পরিচয় দেওয়া হয়েছিল, আচমকাই কর্মক্ষেত্রে সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়েছিলেন। বিবিসি-র ২০১৫-এর ৩ মার্চ প্রকাশিত হওয়া রিপোর্ট তেমনই তথ্য দিচ্ছে। 

বিবিসি-র প্রকাশ করা প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল যে মিস্টার এ প্রবল হৃদরোগে আক্রান্ত হয়েছিলেন। মুহূর্তের মধ্যে তাঁর মস্তিস্কে অক্সিজেনের সঞ্চাচলন বন্ধ হয়ে যায়। থেমে গিয়েছিল হার্টবিট। চিকিৎসাশাস্ত্র অনুযায়ী মিস্টার এ তখন মৃত। হাসপাতালে যখন মিস্টার এ-কে আনা হয়েছিল তখন তাঁর কোনও সংজ্ঞাও ছিল না। 

Latest Videos

চিকিৎসকরা সমানে মিস্টার এ-কে শক থেরাপি দিতে থাকেন যদি কোনওভাবে তাঁর হৃদযন্ত্রকে সচল করা যায়। এরপর চমকের পালা। চিকিৎসকরা যখন এক্কেবারে হাল ছেড়ে দিয়েছেন তখন দেখা যায় আস্তে আস্তে সচল হয়ে উঠেছে মিস্টার এ-র হৃদস্পন্দন। জ্ঞান ফেরার পর মিস্টার এ যা বলেন তাতে চোখ কপালে সকালের। 

মিস্টার এ জানিয়েছিলেন, তাঁকে শক থেরাপি দেওয়ার জন্য চিকিৎসকরা দৌঁড়ঝাঁপ করছিলেন। তিনি সব শুনতে পাচ্ছিলেন। এরপর তিনি আবছা দৃষ্টিতে নাকি দেখতে পান তাঁর মাথার কাছে এক মহিলা দাঁড়িয়ে রয়েছে। যার মুখটা শান্তিতে ভরা। এই মহিলা নাকি শূন্যে ভাসছিলেন। তিনি নাকি মিস্টার এ-র মুখের উপরে দৃষ্টি নিক্ষেপ করেছিলেন। মিস্টার এ- এরপর আরও জানিয়েছেন যে তিনি দেখতে পান তিনি তাঁর শরীরে বাইরে চলে এসেছেন। তাঁর শরীরটা বেডে শোয়ানো এবং চিকিৎসকরা সমানে চিৎকার করে চলেছেন। এরমধ্যে একজন নেড়া মাথার চিকিৎসকও ছিলেন। মিস্টার এ জানিয়েছেন, যে মহিলাকে দেখেছিলেন শূন্য়ে ভেসে থাকতে তাকে দেখে মনে হচ্ছিল যেন তাঁকে নিতে এসেছেন। ওই মহিলাকে প্রবল বিশ্বাস করছিলেন তিনি। এরপর কি হয়েছে তা আর বলতে পারেননি মিস্টার এ। 

মিস্টার এ-র জ্ঞান ফেরার পর তার বয়ান নথিভুক্ত করা হয়েছিল। হাসপাতালে যে চিকিৎসক এবং নার্স ও মেডিক্যাল স্টাফরা মিস্টার এ-র চিকিৎসা করছিলেন তারা বহু সময় আগেই ওয়ার্ড থেকে বেরিয়ে গিয়েছিলেন। প্রকৃত অর্থে মিস্টার এ-র তাদের দেখা বা চিহ্নিত করার মতো জ্ঞানেই ছিলেন না। কিন্তু, জ্ঞান ফেরার পর মিস্টার এ যে চিকিৎসা কর্মীদের কথা বলেছিলেন তারা সকলেই চিকিৎসার সময় সেখানে যে উপস্থিত ছিল তা নিশ্চিত করেছিল হাসপাতাল। 

মিস্টার এ-এর মৃত্যুর স্বাদ নেওয়ার অভিজ্ঞতার কাহিনি পরবর্তীকালে পেপার ইন দ্য জার্নাল রিসাসসাইটেশনেও প্রকাশিত হয়েছিল। কিন্তু মিস্টার এ-এর প্রকৃত পরিচয় প্রকাশ করা হয়নি। বিবিসি-র প্রকাশ পাওয়া এই প্রতিবেদনে আরও বলা হয় যে মিস্টার এ-এর এই মৃত্যু অভিজ্ঞতাকে  গবেষকরা মস্তিস্কের মধ্যে রক্তা সঞ্চালন বন্ধ থাকার প্রতিবর্ত ক্রিয়া বলে ব্যাখ্যা করেন। কেউ আবার বলেন, এটা একজন মানুষের ভ্রম। চিকিৎসকরা এই বয়ানকে স্বীকৃত দিতে চাননি। আর গবেষকদের মধ্যে অনেকে একে কল্পনা বা পূর্ব-কল্পনার প্রসূত অবেচতন মনের এক অলীক বাস্তব বলে প্রতিপন্ন করেছিলেন। 

তবে, মৃত্যুর স্বাদ কেমন আজও এই নিয়ে বিশ্ব জুড়ে গবেষণা চলছে। জানার চেষ্টা চলছে মৃত্যুর পর মানুষের যাত্রা কীভাবে হয়, তা জানার। আদৌ কি মৃত্যুর পর কোনও জগত রয়েছে, নাকি নশ্বর দেহের সমাপ্তির সঙ্গে সঙ্গে মানুষের আত্মারও প্রগতির মৃত্যু হয়! আর এমনই এক গবেষক হলেন নিউ ইয়র্কের স্টোনি ব্রুক ইউনিভার্সিটি স্কুল অফ মেডিসিন-এর রিসাসসাইটেশন রিসার্চ-এর ডিরেক্টর এবং একজন ক্রিটিক্যাল কেয়ার ফিজিশিয়ান স্যাম পার্নিয়া। যিনি আমেরিকা এবং ব্রিটেনের ১৭টি গবেষণা প্রতিষ্ঠানের সহযোগিতায় তাঁর বেশকিছু সহকর্মীকে নিয়ে মৃত্যুর দুনিয়ার হালহকিকতের খোঁজে নিমজ্জিত। 

বিশ্বজুড়ে পার্নিয়া এবং তাঁর দল চার বছর ধরে ২০০০ এমন মানুষের কেসস্টাডি নিয়ে গবেষণা করেন যারা প্রবল হৃদরোগে আক্রান্ত হয়েছিলেন। এমনকী এই সব মানুষদের মধ্যে মাত্র ১৬ শতাংশ চিকিৎসাশাস্ত্রের ভাষায় মৃত্যুর দেশ থেকে ফিরে এসেছিলেন। হৃদস্পন্দন শুধু থেমে যায়নি, এদের মস্তিস্কে রক্ত চলাচলও বন্ধ হয়ে গিয়েছিল কিছু সময়ের জন্য। এমন ১০১ মানুষের সঙ্গে পার্নিয়া এবং তাঁর দল কথা বলতে সমর্থ হয়েছিল। 

এই গবেষণায় পার্নিয়ারা মোট ৭টি এমন জিনিসের কথা জানতে পারেন, যেগুলোর মধ্যে দিয়ে নাকি মৃত্যুকে প্রত্যক্ষ করেছিলেন এই ১০১ জন। তবে, মৃত্যুর সেই অভিজ্ঞতা নিয়ে ৫০ শতাংশই সেভাবে এমন কিছু বলে উঠতে পারেননি যা থেকে একটা ধারনা তৈরি হতে পারে। এই সাক্ষাৎকার পর্বে পার্নিয়ারা এমন এক জন মহিলার সঙ্গে কথা বলেছিলেন যিনি সাউদাম্পটনের সেই মিস্টার এ-র মতো তাঁর মৃত্যু অভিজ্ঞতাকে বিস্তারিতভাবে ব্যাখ্যা করতে পেরেছিলেন। মৃত্যুর স্বাদের সঙ্গে যে সাতটি বিষয়ের কথা বারবার পার্নিয়াদের সামনে আসে, সেগুলি হল- ভয়, কোনও পশুর দর্শন অথবা গাছকে প্রত্যক্ষ করা, একটা উজ্জ্বল আলো, হিংসা বা কোনও খারাপ পরিস্থিতি প্রত্যক্ষ করা, দেজা ভুঁ বা অবাক করে দেওয়া কোনও অনুভূতি, পরিবারকে দেখতে পাওয়া, কোনও ঘটনাকে স্মরণ করা। 

পার্নিয়াদের গবেষণায় একজন জানিয়েছিলেন যে, তিনি আচমকাই দেখতে পান একটা অনুষ্ঠান। সেখানে নাকি মানুষজনকে জ্যান্ত পোড়ানো হচ্ছিল। আর তা নিয়ে উল্লাস করছিল একদল মানুষ। সামনে সারি সারি কফিনও দেখতে পেয়েছিলেন তিনি। ওই সব কফিন নাকি আবার কবর দেওয়া হচ্ছিল। আবার একজন বলেছিলেন, আচমকাই মনে হল কেউ যেন তাঁকে টেনে নিয়ে গভীর জলের মধ্যে ফেলে দিয়েছে। পার্নিয়ারা যাদের সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন তাঁর মধ্যে ২২ শতাংশ-ই নাকি জানিয়েছিলেন এক সুন্দর ও ভালোলাগা অনুভূতি কাজ করছিল। নিজেদের নাকি অনেক হালকা ও চাপমুক্ত মনে হচ্ছিল তাঁদের। আবার একজন বলেছেন, আচমকাই চোখের সামনে অসংখ্য গুল্ম এবং লতাপাতা যেন জেগে উঠছিল। চারিদিকে জঙ্গল। গাছের পাতা সমানে মেলে উঠছিল। আর একজন বলেছেন, হঠাৎই একটা উজ্জ্বল আলোয় চারিদিকে ভরে যেতে দেখেছিলেন। সেই আলোয় মনে হচ্ছিল তিনি হারিয়ে যাবেন। আবার ভারত থেকে একজনের সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন পার্নিয়ারা। তাদের গবেষণায় নাকি সেই ভারতবাসী জানিয়েছিলেন তিনি সাক্ষাৎ ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে দেখতে পেয়েছিলেন। 

পার্নিয়া জানিয়েছেন, তাদের গবেষণায় মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে আসা মানুষরা যেটা বলেছিলেন সেটাই পুঙ্খনাপুঙ্খভাবে তারা তুলে ধরেছিলেন। এখানে কোনও অনুমান ভিত্তিক বক্তব্য় রাখা হয়নি। কিন্তু, এই সব বয়ানের পিছনে এমন কিছু বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা পার্নিয়াদের কাছে মজুত রয়েছে তাতে কোনওভাবেই এগুলোকে মৃত্যুর মুহূর্তের পরিস্থিতি বলে ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয়। কারণ মানুষের মস্তিস্ক এতটাই জটিল যাকে নিয়ে আজও পুরো গবেষণা সম্ভব হয়নি। সুতরাং এই বিষয়গুলিকে নিয়ে লাগাতার গবেষণা চালানো গেলে একটা দিশা পাওয়া সম্ভব বলে মনে করেন পার্নিয়া। তবে, সন্দেহ নেই যে সব মানুষ প্রায় মরতে মরতে বেঁচে ফিরেছেন তাদের বলা এই সব অভিজ্ঞতা মানুষের মনে কিছু প্রতিক্রিয়া তৈরি করবেই। তবে, একে নিশ্চিতভাবে যে মৃত্যুর পরের ধাপ বলা যাবে- এমনটা নয়। 

Share this article
click me!

Latest Videos

Rohit Sharma-কে দেখে উল্লাসে মেতে উঠলেন ভক্ত! দেখুন সেই মুহূর্ত #shorts #shortsfeed #shortsfeed
'এখন থেকেই ব্যাগ গোছান, ২৬-এ ওরা ক্ষমতায় আসলে...' চরম সত্যটা বলে দিলেন শুভেন্দু | Suvendu Adhikari |
Suvendu Adhikari : ছোট্ট অস্মিকার পাশে এবার শুভেন্দু অধিকারী, দেখুন কী বলছেন তিনি
‘Mamata Banerjee West Bengal-কে জঙ্গিদের হাতে তুলে দিতে চান’ মমতাকে চরম তুলোধোনা Suvendu Adhikari-র
মমতার খেলা ধরে ফেললেন শুভেন্দু | Suvendu on Mamta #shorts #suvenduadhikari #mamatabanerjee