আখতারি বাই ফৈজাবাদী থেকে বেগম আখতার এর অজানা গল্প

 

  • মেয়ের মাকে কখনও স্বীকারই করেননি স্বামী
  • মা সামান্য এক ব্যবসায়ীর মেয়ে
  • ফৈজাবাদ থেকে না পালিয়ে আর উপায় ছিল না
  • ঘোষিত হল এক নতুন তারার জন্ম

ফৈজাবাদের একটি স্কুল ঘুরে দেখছেন গহরজান। হঠাৎই তাঁর ওড়নায় টান পড়ে। ঘাড় ঘুরিয়ে তিনি দেখেন, ছোট্ট একটি মেয়ে তাঁর বহু দামী ওড়নাটির দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। গহর সস্নেহে মেয়েটিকে জিজ্ঞেস করেন, ‘কী নাম তোমার?’ মেয়েট যখন তার নাম বলছিল, তখনই তার কণ্ঠস্বর শুনে গহরজান বুঝতে পারেন, মেয়েটি গান গায়। গহর মেয়েটিকেগান গাইতে বললে সে একটি কলি গেয়েছিল। ওই কলিটি তার জীবনে প্রথম গাওয়া গান।তার আগে সে কোনও দিন গান গায়নি। কিন্তু সেই এক কলি গান শুনেই গহর মনে মনে বলেছিলেন, এই মেয়ে এক দিন বিরাট বড় শিল্পী হবে।

কিন্তু জীবন বড় আশ্চর্য এবং জটিল গল্পের দৃশ্যপট।এই মেয়ের মাকে কখনও স্বীকারই করেননি তাঁর স্বামী। কারণ তিনি ব্রিফলেস ব্যারিস্টার হলেও সৈয়দ বংশের সন্তান; আর অসামান্য সুন্দরী হলেও মেয়েটির মা সামান্য এক ব্যবসায়ীর মেয়ে। অতএব তাঁর জাত নেই। ফলে, যমজ কন্যার জন্ম দিয়ে একা থাকতে হত তাঁকে। এক দিন মায়ের আড়ালে চার বছর বয়সী মেয়েদের হাতে বিষ মাখানো মিষ্টি দিয়ে গেল তাদের পিতৃকুলের লোক, মারা গেল এক মেয়ে, বেঁচে থাকল একটি। এরপর তাদের বাড়িতে আগুন লাগিয়ে দিল মেয়েটির পিতৃবংশের ভাড়া করা গুণ্ডারা,  কিন্তু বেঁচে গেল মা-মেয়ে। 

Latest Videos

এরপর ফৈজাবাদ থেকে না পালিয়ে আর উপায় ছিল না। বেঁচে থাকা মেয়েকে কোলে নিয়ে গয়া স্টেশনে ট্রেন থেকে নামলেন। উঠলেন গয়ায় তাঁর এক দূর সম্পর্কের ভাইয়ের বাড়িতে। শর্ত হল, মা-মেয়ের থাকা খাওয়ার বিনিময়ে গৃহস্থালীর যাবতীয় কাজ করে দেবেন। আর, মেয়ের ভবিষ্যৎ? মায়ের ইচ্ছে, মেয়ে স্কুলে যাবে, লেখাপড়া শিখবে, নিজের পায়ে দাঁড়াবে। মেয়ে কিছুতেই স্কুলে যাবে না। সে পড়বে না, গান শিখবে। সে ব্যবস্থাই হল। বাড়িতে ওস্তাদের কাছে তালিম নিতে থাকল মেয়েটি। 

তালিমের পর গান শোনা। গান শুনতে এলেন কলকাতায়। একটি অনুষ্ঠানে শিল্পিদের তালিকায় গওহর জান, মালকা জান, ছপ্পন ছুরি; খান সাহেবদের মধ্যে আগ্রা ঘরানার শ্রেষ্ঠ গায়ক আফতাব-এ-মৌসিকী ওস্তাদ ফৈয়জ খান, রজব আলি খান, কিরানার প্রাণপুরুষ আবদুল করিম খান, মাইহারের আলাউদ্দিন খান। চ্যারিটি শো; সবাই বিনা পারিশ্রমিকে গাইবেন। আসরের দিন অবশ্য দেখা গেল, উদ্বোধনী শিল্পী বেনারসের সানাইবাদক আমন আলি বক্শ খান ছাড়া সবাই অনুপস্থিত। সেই আসরে প্রথম শ্রোতাদের সামনে সানাই বাজান আলি বক্শের ভাইপো বিসমিল্লাহ খান। মেয়েটির ওস্তাদ ছিলেন চৌকশ লোক। আসরে ওস্তাদদের অনুপস্থিতিতে শ্রোতারা গরম হতে আরম্ভ করেছে দেখেই ছাত্রী আর তার মাকে বসিয়ে রেখে হাজির হলেন ব্যাক স্টেজে। এক উদ্যোক্তাকে ধরে বললেন,  ‘বাঁচতে চান তো আমার ছাত্রীকে বসিয়ে দিন’ বিস্মিত উদ্যোক্তা পাল্টা প্রশ্ন করলেন,  ‘পারবে এত বড় আসর সামলাতে?’  নিজের ছাত্রীর ওপর অগাদ আস্থা ওস্তাদের। নির্ভয়ে উত্তর জানালেন, ‘পারবে না মানে!’ ছাত্রীর মা সানন্দে রাজি হয়ে গেলেন। গুরুজিও সঙ্গে সঙ্গে ছাত্রীকে নিয়ে স্টেজে হাজির হলেন।  

এগারো বছরের মেয়ে সেদিন কলকাতার ওই সঙ্গীত আসরের উদ্যোক্তাদের শুধু বাঁচিয়ে দেন নি মাত করে দিয়েছিল গোটা অনুষ্ঠান। শ্রোতারা শিল্পী তালিকা ভুলে শুধু তার গানই শুনে গেলেন। তখন কলকাতার রইসদের তারিফ পাওয়া ছিল হিন্দুস্থানের গাইয়ে বাজিয়েদের চূড়ান্ত শিলমোহর। খবর কাগজওয়ালারা উচ্ছ্বসিত, ঘোষিত হল এক নতুন তারার জন্ম। ওই অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন সরোজিনী নাইডু। সরোজিনী একটি খাদি শাড়ি উপহার পাঠিয়ে এই নবীন শিল্পীকে তাঁর আশীর্বাদ জানান। মেগাফোন সংস্থার বড়কর্তা জে এন ঘোষ চুক্তি করলেন মেয়ের মায়ের সঙ্গে। রিপন ষ্ট্রিটে ফ্ল্যাট হল, গাড়ি হল, নতুন ডিস্ক বেরোল, কিন্তু গান আর তেমন হিট করল না। ঘোষবাবুর কপালে ভাঁজ। মেয়ের মাকে সোজা জানিয়ে দিলেন, আর একটা রেকর্ড, সেটা চললে ভাল, নচেৎ চুক্তি বাতিল। মাথায় বজ্রাঘাত; সারা জীবন বিপদ আর দারিদ্রের সঙ্গে লড়াই করে কেটেছে। এই প্রথম মেয়ের কল্যাণে সুখের মুখ দেখেছেন তিনি। কোনো ভাবেই সে সুখকে হাত ফসকে যেতে দেবেন না। ঘোষবাবুর কাছে কয়েকটা দিন সময় চেয়ে নিয়ে সোজা বেরিলি। 

এলেন তাঁর গুরু, পীর আজিজ মিয়ার কাছে। পীর সব শুনে বললেন, ‘কলকাতায় গিয়ে যে গানটা গাইবি, সেই পাতাটা আমার সামনে খুলে ধর তো বেটি’। মেয়েটি খাতা খুলল, সেই পাতায় হাত রাখলেন আজিজ মিয়া। বললেন, ‘শোহরত তুমহারি কদম চুমেগি, দৌলত তুমহারি বান্দি হো কর ঘুমেগি’। মা মেয়ে আর দেরি করলেন না। ট্রেন ধরে সোজা কলকাতা, হাওড়া স্টেশন থেকে সরাসরি ঘোষবাবুর অফিসে, বললেন রেকর্ডিং-এর আয়োজন করতে। আখতারি বাঈ ফইজাবাদি গাইলেন: ‘দিওয়ানা বানানা হ্যায় তো দিওয়ানা বানা দে’। বাকিটা সাফল্যের ইতিহাস।

Share this article
click me!

Latest Videos

'উনি চক্রান্তের বড় শিকার' নেতাজির জন্মদিনে এ কী বললেন মমতা? Mamata on Netaji
রাগের মাথায় এ কী করে বসলো স্বামী! দেখলে আঁতকে উঠবেন, চাঞ্চল্য Nadia-এ | North 4 Parganas News Today
সুকান্ত মজুমদারকে বিজেপির নবজাতক আখ্যা কুণালের, পাল্টা দিয়ে যা বললেন সুকান্ত : Sukanta on Kunal
নেতাজির 'মৃত্যুদিন' ঘোষণা রাহুলের, ক্ষোভ উগরে একহাত নিলেন সুকান্ত মজুমদার | Sukanta on Rahul
ED Raid Today: Kolkata-র একাধিক স্থানে ফের ED-র অভিযান! Salt Lake-এ হাজির বিশাল ইডির দল | Kolkata