অরণ্য, মেঘ, কুয়াশা গাছের গায়ে-পাতায় মিড় লাগিয়ে যুগলবন্দী রচনা করে চটকপুরে

  • পাহাড়ি রাস্তা, দূরদিগন্তে লম্বা লম্বা পাইনের জঙ্গল
  • আকাশটা এক্কেবারে ঘন নীল আর উজ্জ্বল
  • পাহাড়ির মোরাম বিছানো রাস্তা যেন মায়াবী
  • গাছের পাতার শিরশারানি আওয়াজ যেন খুলে দেয় অন্য জগত

 

চটকপুর নামটায় অন্যরকম ব্যাপার আছে।  এই নাম শুনলেই মনে হয় গল্প শুরু হবে উপকথার।  সেই গল্পে  যদি পাহাড় থাকে প্রেক্ষাপটে তাহলে যেমন পাহাড়ি গ্রামের কল্পনা পাঠকরা করবেন তেমন কল্পছবি মিলে যাবে আসল জায়গার সঙ্গে। পুজোয় গিয়েছিলাম চটকপুরে। সপ্তমীর রাতে হাতে এগ চিকেন রোল হাতে চটকপুরের সন্ধেটা আন্দাজ করার মধ্যে যে রোমান্টিকতা আছে সেটাই ছিল এবার আমার পুজোর থিম। কলকাতার রাস্তা জুড়ে মানুষের কাতার, সেলফি,  পুজোর উদ্বোধনে সেলিব্রিটির সমাগম,  আলোয় মোড়া অলিগলি, রাস্তা জুড়ে বিসর্জনের হুল্লোড় এসবের ঠিক বিপরীতে চটকপুর দাঁড়িয়েছিল দু হাত বাড়িয়ে, কোলাহল-হীন দিন,  বিবাগী দুপুর, নিঝুম রাত সঙ্গে নিয়ে।

চটকপুরে যাওয়ার রাস্তার সঙ্গে কার তুলনা টানব ঠিক করতে পারছি না। কোন প্রাচীন অরণ্য এরকম ছিল? বা আজও আছে? জানিনা। সব অরণ্য দেখা হলে হয়তো মিল পেয়ে যাব কিংবা পাব না। দুর্গম রাস্তার গায়ে আদিম সেঞ্চেল অরণ্য, মেঘ কুয়াশা গাছের গায়ে-পাতায় মিড় লাগিয়ে যে যুগলবন্দী রচনা করছিল তার দ্যোতনাই ছিল এ সফরের পাওনা। জঙ্গলের শব্দ, জলভরা মেঘ, পথে এলোমেলো ঝরনা বুকের মধ্যে এসে বাজছিল এমনভাবে যেন প্রশ্ন করছে যে, ‘আমাদের ছাড়া এতদিন কীভাবে বেঁচেছিলে তোমরা?’ হাজারো রঙিন ফুল গাড়ির মধ্যে সেঁধিয়ে পড়ছে আদর করবে বলে। এতই ঘন জঙ্গল আর এত সরু রাস্তা যে গাছেরা নির্দ্ধিধায় ঢুকে পড়ে গাড়ির মধ্যে। এসব যে ঘটছে তা যে জাদুবাস্তব নয় তা বুঝতে দেরি হয়ে যায়। ‘জগতে আনন্দযজ্ঞে আমার নিমন্ত্রণ’ এ গান গুনগুন করি বাকি রাস্তা, যাতে বুঝতে পারি এ সমস্ত দৃশ্য চোখের সামনেই বয়ে চলেছে। অন্তরে অনন্ত চমকের খেলা চলতে থাকে। প্রতিবার উত্তরবঙ্গ থেকে ফিরে ভাবি ‘এর থেকে আরও ভালো আর কিছু হয়না’।  ভুল প্রমাণিত হই আর এমন বারবার ভুলেই অপার আনন্দ নুপূর বাজায় অন্তরমহলে। 
মাত্র ১৯টি পরিবার চটকপুরে। তাদের মধ্যে বেশিরভাগই একে অপরের আত্মীয়। তারাই যোগান দেন আশ্রয়, আহার, বিশ্রাম ভ্রমণার্থীদের। বেশিরভাগ বাড়িতেই আছে হোম-স্টে। বাড়ির মতো থাকো আর খাও দাও রেস্ট নাও। বাজবে না ফোন, টিভিহীন সন্ধেরা ঘরে ঘরে গল্প-গানের মৌতাত জমাবে, সঙ্গে সুস্বাদু খাবার- ‘এর বেশি কি চাওয়ার আছে? এর বেশি কে চায়?’
 
পাখি, প্রজাপতি, কাঞ্চনজঙ্ঘা এ সব তো আছেই। সকাল থেকেই ক্যামেরা নিয়ে হেঁটে হেঁটে ওয়াচ টাওয়ার কিংবা জঙ্গলের ভেতর পৌঁছলেই অজস্র মুহূর্তরা জন্ম নেবে। গাইড নিয়েও যাওয়া যায় কিংবা একা একা।  অনন্য সুন্দর এক পথ  সিঞ্চেল জঙ্গলের ভেতর দিয়ে পাহাড়ের গা ঘেঁষে কালি পোখরি অবধি টেনে নিয়ে যাবে। কালো ছোট্ট জলাশয়ের ওপর প্রকান্ড এক কালচে পাথর। কেমন প্রাচীন পৃথিবীর কথা মনে করায়। এখানেই কি জল খেতে আসে বন্যরা? যেন দেখতে পাই কল্পনায়। ওই পাথরের ওপর নিশ্চই ল্যাজ ঝুলিয়ে বসে রাজা সাজে কোনও চতুর চিতা? এমন গহীন জঙ্গলের মধ্যে নক্ষত্র কিংবা উল্কা খসে পড়েছিল কি কোনওদিন? জঙ্গলের পাশেই খাড়া পাহাড় হয়তো গড়িয়ে এসেছে সেখান থেকেই এক প্রকান্ড টুকরো। এমন কিছুই হয়তো নয় কিন্তু আমায় ঘোর লাগায় ওই কালো জল, স্থির পাথর আর জলের ওপর গাছের ছায়া, মেঘের ছায়া। জলের ধার ঘেঁষে ঘাসের বন কাশের কথা মনে করায়। মায়াবী পিছুটান আছেই কালো পোখরির। অলীক কিছু ঘটলেই মানুষ ঈশ্বরের দ্বারস্থ হয়। এখানেও পাহাড়ি জায়গায় ছোট্ট জলাশয় অলৌকিক মাহাত্ম্যে পৌঁছে গেছে তাই একটি ভাঙা অমসৃণ গাছে কান্ডের ওপর লাল কাচের চুড়ি ঝুলিয়ে দিয়ে দেবী মায়ের প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে আর আছে অনতিদূরে একখানি শিবের ত্রিশূল ও জলে তাপে বিবর্ণ হয়ে যাওয়া একখানা মহাদেবের ছবি। বাহুল্যবর্জিত মহিমাগাঁথা দেখলে সরল লোকায়ত জীবনের উদ্দেশ্যে মাথা ঝোঁকাতে ইচ্ছে হয়। 

Latest Videos

একইরকম উচ্চতার মাথা উঁচু করা পাহাড়ি গাছ,  হঠাৎ হঠাৎ নেমে আসা মেঘের দল ও কিছুক্ষণ থেকেই ভ্যানিশ হয়ে যাওয়া, রঙিন কাঠের বাড়িগুলো ঘিরে অজস্র ফুল, ফুলের ওপর বসে থাকা প্রজাপতি, বাড়ির সিঁড়িতে, কাঠের পাঁচিলে কমলা শ্যাওলা এমন এক রঙের ম্যাজিক তৈরি করেছে যা দেখতে দেখতে বেলা কেটে যেত তবু আশ মিটত না। একসময় যে জায়গা কাঠ চোরা শিকারিদের বিচরণভূমি ছিল, বন দপ্তর ও আঞ্চলিক মানুষের শুভ উদ্যোগে যে আমূল পরিবর্তন সাধিত হয়েছে তা দেখে বারবার মনে হচ্ছিল যে মানুষ চাইলে সব হয়।   এই জঙ্গলে চিতা, লেপার্ড, রেড পন্ডা আছে বলে জানান স্থানীয় মানুষজন।  ভয়ের চোরা টান বয়ে যায় জঙ্গলের এবং জন্তুদের গল্প শুনতে শুনতে।এখানকার মানুষের আতিথেয়তা, হাসিমুখ, কথা, যত্ন সব থেকে যায় সম্পদ হয়ে। এমনটাই হয় বারবার পাহাড়ে, তাই ছেড়ে আসতে মন চায় না। কথা দিয়ে আসি ফিরে যাওয়ার।

কিভাবে যাবেন- রোহিনী-কার্সিয়াং-টুং সোনাদা পেরিয়ে যেতে হবে। সোনাদা থেকে সাত কি.মি রাস্তা জুড়ে সিঞ্চেল জঙ্গল, তারপরেই চটকপুর। যদি কেউ শেয়ার জিপে যেতে চান তাহলে তিনি সোনাদা অবধি যেতে পারবেন শেয়ার জিপে করে, তারপর হোম-স্টের সঙ্গে আগে থেকে কথা বলা থাকলে ওরা গাড়ি ঠিক করে দেবে সোনাদা থেকে চটকপুর অবধি।  

থাকার জায়গা-  প্রচুর হোম-স্টে এবং পশ্চিমবঙ্গ সরকারের ফরেস্ট বাংলো রয়েছে। 
 

Share this article
click me!

Latest Videos

Saline : ফেরেনি হুশ! মালদার হরিশ্চন্দ্রপুর গ্রামীণ হাসপাতালে ব্যবহার হচ্ছে নিষিদ্ধ স্যালাইন | Malda
Canning-এ ঘটে গেল বড় দুর্ঘটনা! বাড়ি ফেরার পথেই প্রাণঘাতী ধাক্কা লরির,দেখুন
Suvendu Adhikari : রাজ্য সড়ক অবরোধ করে জন্মদিন পালন তৃণমূল কাউন্সিলরের, গর্জে উঠলেন শুভেন্দু
Sukanta Majumdar Live: স্বামী বিবেকানন্দের জন্ম জয়ন্তী উদযাপনে সুকান্ত, দেখুন সরাসরি
'স্বাস্থ্যমন্ত্রী পদত্যাগ করুন, দুর্নীতির আঁতুড়ঘর স্বাস্থ্য দপ্তর' স্বাস্থ্য ভবন ঘেরাও Congress-এর