ভোটের ঘণ্টা বাজার আগেই জনপ্রিয় হয়েছিল তৃণমূলের 'খেলা হবে' স্লোগান
বিজেপি পাল্টা তুলেছে বিকাশের স্লোগান
কিন্তু, এই স্লোগান কতটা প্রভাব ফেলবে মানুষের মনে
কী কী বিকাশের কথা বলছে তারা
ভোটের ঘণ্টা বাজার আগেই তৃণমূলের গান বেরিয়ে গিয়েছিল, ‘বন্ধু এবার খেলা হবে।’ বিশ্বের বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশে ভোটকে নিয়ে ‘খেলা’ করার এই প্রবণতা শুধু উদ্বেগের কারণ নয়, বিপজ্জনকও বটে। বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গের মতো রাজ্য, যেখানে শিল্পায়ন তলানিতে এসে ঠেকেছে, কর্মসংস্থানের আশায় ভিন্ রাজ্যে পাড়ি জমাতে হচ্ছে যুবসমাজকে। বিজেপি তাই ‘খেলা হবে’র পাল্টা ‘বিকাশ হবে’র স্লোগান তুলেছে ভোটপ্রচারে। পুরুলিয়ার সভায় এসে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী বলে গিয়েছেন, ‘দিদি বলেন খেলা হবে। বিজেপি বলে বিকাশ হবে। বিজেপি বলে শিক্ষা হবে। মহিলাদের উত্থান হবে। বিজেপি বলে যুবশক্তির সম্পূর্ণ বিকাশ হবে। চাকরি হবে। পরিষ্কার জল হবে। গ্রামে গ্রামে হাসপাতাল হবে।’
নির্বাচনী ইস্তাহার সোনার বাংলা সংকল্প পত্রেও মোদীর এই কথাগুলোকে ধরে ধরে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে। বাংলার সর্বাঙ্গীন বিকাশের উপরে জোর দিতে সংকল্পপত্রে প্রথমেই এসেছে মহিলাদের উন্নয়নের কথা। তারপরে চাষিবন্ধু, যুবসমাজ, পরিকাঠামোর উন্নয়ন, শিল্পায়নের প্রসঙ্গগুলি এক-এক করে এসেছে।
শিল্পায়ন প্রসঙ্গে বেশ কিছু ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্ক তৈরি করার প্রতিশ্রুতি সংকল্পপত্রে রেখেছে বিজেপি। ২টি লেদার ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্ক, একটি স্টিল ও আয়রন ইঞ্জিনিয়ারিং ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্ক, একটি ফার্মা পার্ক, একটি জুয়েলারি ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্ক তৈরি করার কথা বলা হয়েছে। পাটশিল্পকে চাঙ্গা করতে দেড় হাজার কোটি টাকার একটা ফান্ড করা হবে। এছাড়াও, অতি ক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের উপরে জোর দিতে বেশ কিছু ব্যবস্থা থাকছে। ২ টাকা প্রতি ইউনিটে বিদ্যুৎ থেকে শুরু করে সহজে লোন পাওয়া তার মধ্যে অন্যতম। স্টার্ট-আপদের জন্য রয়েছে পাঁচ বছরের ‘ট্যাক্স হলিডে’। সংকল্পপত্রে ৪টি বড় ও ১০টি ছোট ফুড পার্ক, দু’টো সি-ফুড প্রসেসিং পার্ক, ৪টি বস্ত্র হাব, ১টি হস্তশিল্প হাব তৈরি করার কথা বলেছে বিজেপি।
কর্মসংস্থানের কথা মাথায় রেখেই প্রতি ব্লকে একটা করে বিপিও তৈরির কথা বলা হয়েছে ইস্তাহারে। এছাড়াও প্রতি ব্লকে একটা করে ভেকেশানাল ট্রেনিং সেন্টার থাকবে। ১০০টি নতুন কলেজ ও ৫০টি পলিটেকনিক কলেজ গড়ার জন্য ১০ হাজার কোটি টাকার বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ফান্ড গড়া হবে। বিজেপি-র ইস্তাহারে বলা হয়েছে, তফসিলি জাতি, উপজাতি, দুর্বল, অনগ্রসর শ্রেণি ও মেয়েদের স্কুলের বই, ব্যাগ, ইউনিফর্ম, বাইসাইকেল ও নবম শ্রেণি পাশ করলে ডিজিটাল ট্যাবলেট দেওয়া হবে বিনামূল্যে। এই জন্য সহজ পাঠ প্রকল্পে ৫০০ কোটি টাকার আলাদা ফান্ড থাকবে। স্কুলের পরিকাঠামো উন্নয়ন ও নতুন পাঁচটি বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে তোলার জন্য ২০ হাজার কোটি টাকার ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ফান্ডের কথা রয়েছে বিজেপি-র ইস্তাহারে।
আরও পড়ুন - মুখ্যমন্ত্রীর দৌড়ে বেশি পিছিয়ে নেই দিলীপ, কে পাবে বাংলার তাজ - কী বলছে জনমত সমীক্ষা
আরও পড়ুন - মমতার পোশাক নিয়ে 'অশালীন' মন্তব্য - বিতর্কে বিজেপি সভাপতি, কী বলেছিলেন দিলীপ
আরও পড়ুন - 'ভাইপো'র জন্যই কি ডুবছে তৃণমূল, নাকি আসন্ন নির্বাচনে তিনিই 'দিদি'র অক্সিজেন
পরিকাঠামোর উন্নয়নের ক্ষেত্রে পাকা বাড়ি, রাস্তা ও পানীয় জল সরবরাহের উপরে গুরুত্ব দিতে চাইছে বিজেপি। ৬৭৫ কিমি নেতাজি এক্সপ্রেসওয়ে দ্রুত বানানোর প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে সংকল্পপত্রে যা আগামী দিনে বাংলার লাইফলাইন হবে বলে আশা করা হয়েছে। বাংলার শহরের পরিকাঠামো উন্নয়নে উজ্জ্বল বাংলা মিশনে ৩০ হাজার কোটি টাকা খরচ করা হবে। নতুন রাস্তাঘাট তৈরি ও পুরনোগুলির সংস্কারের পিছনে পাঁচ বছরে এক লক্ষ কোটি টাকা পর্যন্ত খরচ করার কথা বলা হয়েছে সংকল্পপত্রে। বাগডোগরাকে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে উন্নীত করার পাশাপাশি মালদা, বালুরঘাট, কোচবিহার, পুরুলিয়ায় নতুন বিমানবন্দর তৈরি করা হবে।
মেয়েদের উন্নয়নে রয়েছে একগুচ্ছ প্রতিশ্রুতি। সরকারি চাকরিতে মেয়েদের জন্য ৩৩ শতাংশ সংরক্ষণ থাকবে। সর্বোপরি, মেয়েদের প্রাথমিক থেকে উচ্চশিক্ষা পর্যন্ত সমস্ত খরচ মকুব করে দেওয়া হবে। এমনকী সরকারি পরিবহণ ব্যবস্থায় বিনামূল্যে যাতায়াত করতে পারবে মেয়েরা। তফসিলি ও অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণি ও আর্থিক দিক থেকে পিছিয়ে থাকা পরিবারে কন্যা সন্তান জন্ম নিলেই ৫০ হাজার টাকার বন্ড দেওয়া হবে। এই শ্রেণির পরিবারে ১৮ বছর বয়সের পরে বিয়ে হলে মহিলাদের জন্য ১ লক্ষ টাকার ফিক্সড ডিপোজিট করে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি রয়েছে ইস্তাহারে। মমতার সরকারের কন্যাশ্রী প্রকল্প বেশ জনপ্রিয়। তার টেক্কা হিসাবে বিজেপির ইস্তাহারে ১৮ বছর বয়সের পরে মেয়েদের ২ লাখ টাকা দেওয়া হবে বলে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে। এই প্রকল্পের নাম ‘বালিকা আলো’। বলা হয়েছে, ছাত্রীরা ষষ্ঠ শ্রেণিতে উঠলেই বছরে তিন হাজার, নবম শ্রেণিতে পাঁচ হাজার এবং একাদশ শ্রেণিতে উঠলে সাত হাজার টাকা করে পাবে।
আরও পড়ুন - বঙ্গ ভোটে পদ্ম হাতে ৯ মুসলমান, বিজেপি কি সত্যিই সংখ্যালঘু-বিরোধী - কী বলছেন প্রার্থীরা
আরও পড়ুন - মমতা, আব্বাস না বিজেপি - কোথায় যাবে মুসলিম ভোট, বাংলার নির্বাচনে এবার সবথেকে বড় ধাঁধা
আরও পড়ুন - বাংলার ২৯৪ আসনের ভোটগ্রহণের কেন্দ্র-ভিত্তিক সম্পূর্ণ সূচি - আপনার ভোট কবে, দেখে নিন
মহিলাদের পরেই কৃষকদের উন্নয়নে নানান প্রতিশ্রুতি রয়েছে ইস্তাহারে। কেন্দ্রের পিএম কিসান যোজনা প্রকল্পটি দ্রুত এই রাজ্যে বলবত করা হবে বলে জানিয়েছে বিজেপি। এই প্রকল্পে চাষিদের বছরে ৬ হাজার টাকা করে দেওয়া হয়। পশ্চিমবঙ্গে প্রকল্পটি এখনও চালু না হওয়ার কারণে যে বকেয়া, সেই ১৮ হাজার টাকা ৭৫ লক্ষ চাষির অ্যাকাউন্টে পাঠিয়ে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে বিজেপি-র ইস্তাহার ‘সোনার বাংলা সংকল্প পত্রে’। ৬ হাজারের বদলে এই রাজ্যে ১০ হাজার টাকা করে চাষিদের দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে বিজেপি। এছাড়াও চাষিদের সামাজিক সুরক্ষা খাতে ৫ হাজার কোটি টাকার একটি ফান্ড আলাদা থাকবে। থাকছে চাষিদের জন্য পেনশনের ব্যবস্থা। এমনকী চাষি ও মৎস্যজীবী পরিবারগুলিকে বিমার আওতাতেও আনতে চাইছে বিজেপি।
স্বাস্থ্যখাতে প্রথম যে কাজটা করতে চায় বিজেপি তা হল আয়ুষ্মান প্রকল্প দ্রুত এই রাজ্যে বলবত করা। এছাড়াও উত্তরবঙ্গ, জঙ্গলমহল ও সুন্দরবনে তিনটি নতুন এইমস হাসপাতাস গড়ার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে ইস্তাহারে। আশাকর্মীদের ৪৫০০ টাকার বদলে মাসে ৬ হাজার টাকা করে দেওয়া হবে।
কলকাতার পরিকাঠামো উন্নয়নে বহু প্রতিশ্রুতি রয়েছে বিজেপির ইস্তাহারে। কলকাতাকে ইউনেস্কো ‘হেরিটেজ সিটি’র আওতায় আনতে চায় তারা। কলকাতার পরিকাঠামো উন্নয়নে ২২ হাজার কোটি টাকার একটি ফান্ডের পাশাপাশি ৫০০ কোটির ফান্ড রাখা হবে হেরিটেজ তকমা পাওয়ার জন্য। কলকাতা মেট্রো ব্যবস্থাকে শ্রীরামপুর, ধূলাগড় ও কল্যাণী পর্যন্ত সম্প্রসারিত করার প্রতিশ্রুতি রয়েছে ইস্তাহারে। আদিগঙ্গা সংস্কার করে পুরনো অবস্থায় ফিরিয়ে আনার কথাও বলা হয়েছে।
রাজ্যের পর্যটনের পরিকাঠামো উন্নয়নে নানা প্রতিশ্রুতি রয়েছে বিজেপির ইস্তাহারে। পর্যটন শিল্পের উন্নয়নে এক হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ করা হবে। বাংলার ১৩টি শক্তিপীঠকে কলকাতার সঙ্গে যুক্ত করে বিশেষ শক্তিপীঠ সার্কিট তৈরি করা হবে। এছাড়াও বিভিন্ন ধর্মীয় ক্ষেত্রগুলিকে ঘিরে এই ভাবে সার্কিট গড়ে তোলা হবে। জঙ্গলমহল, পাহাড় ও উপকূলের পর্যটনশিল্পের পরিকাঠামো উন্নয়নে থাকছে আলাদা আলাদা প্যাকেজ।
বাংলার শিল্প-সংস্কৃতির উন্নয়নে ১১ হাজার কোটি টাকার পৃথক ফান্ডের কথা বলা হয়েছে বিজেপি-র ইস্তাহারে। নোবেল প্রাইজের মতো করে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর স্মৃতি পুরস্কার দেওয়া হবে। একই ভাবে সিনেমার জন্য থাকবে সত্যজিৎ রায় পুরস্কার। কলকাতা ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম ফেস্টিভ্যালকে আরও উচ্চতায় নিয়ে যাওয়ার কথা বলা হযেছে ইস্তাহারে। এই ভাবে শিল্প, সংস্কৃতি, কর্মসংস্থান, পরিকাঠামোর সার্বিক বিকাশের মাধ্যমে সোনার বাংলা গড়ার স্বপ্ন দেখাচ্ছে বিজেপি। ‘খেলা হবে’র পাল্টা বিজেপির ‘বিকাশ হবে’ স্লোগান কতটা ছাপ ফেলল ভোট-বাজারে, বলবে সময়।