পুরুলিয়ার প্রত্যন্ত গ্রামের যুবক অক্ষয় ভকত অ্যাডভেঞ্চারের নেশা এবং পরিবেশ রক্ষার বার্তা নিয়ে সাইকেলে বিশ্বভ্রমণে বেড়িয়েছেন। প্রথমেই তিনি জয় করলেন বিশ্বের সর্বোচ্চ মোটর-সড়ক লাগাখের খার দুংলা।
প্রত্যেক বাঙালি যুবকের মনের মধ্যেই একটা করে শঙ্কর লুকিয়ে থাকে। যে, অজ পাড়া গাঁয়ে বসেও স্বপ্ন দেখে দেশ দেখার, স্বপ্ন দেখে অ্য়াডভেঞ্চারের। তবে কারোর কারোর ক্ষেত্রে সেটা স্বপ্নই থেকে যায়, আর খুব অল্প মানুষই মনের জোরে তাড়া করে বেড়ান সেই স্বপ্নটাকে। এরকমই একজন পুরুলিয়ার প্রত্যন্ত গ্রামের যুবক অক্ষয় ভকত। সাইকেল নিয়ে বিশ্বভ্রমণে বেরিয়েছেন তিনি। প্রথমেই পৌঁছে গিয়েছেন, 'টপ অব দ্য ওয়ার্ল্ড' নামে খ্য়াত বিশ্বের সর্বোচ্চ মোটর গাড়ি চলার মতো পথ লাগাখ কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের লেহ জেলার খার দুংলায়। ভারতের জাতীয় পতাকা তুলে ধরে তাঁর এই সফর ভারতের করোনা যোদ্ধা এবং 'রিয়েল হিরো' বলিউড অভিনেতা সোনু সুদ-কে উৎসর্গ করেছেন তিনি। পরের গন্তব্য দক্ষিণ আফ্রিকা, বার্তা দেবেন সবুজ এবং বিশ্ব পরিবেশ রক্ষার।
পুরুলিয়ার বাগমুন্ডি ব্লকের বুড়দা গ্রাম। অযোধ্যা পাহাড় কোলের একেবারে প্রত্যন্ত এলাকার এই গ্রামেরই বাসিন্দা অক্ষয় ভকত। এই অজানা অচেনা গ্রামের ছেলে হয়েও, একেবারে ছোটও থেকেই তিনি স্বপ্ন দেখেছিলেন সাইকেল চালিয়ে নিজের দেশ ভারত ও গোটা বিশ্বকে ঘুরে দেখা। কিন্তু, স্বপ্নের পথে প্রধান বাধা ছিল তাঁর পরিবারের আর্থিক অনটন। যে গ্রামে যুবকরা হয় কৃষিকাজ নইলে চোটখাটো কাজকর্ম করে জীবন ধারণ করেন, সেখানে সাইকেল নিয়ে বিশ্বভ্রমণ ছিল দুঃসাহসিক স্বপ্ন। কিন্তু, ওই যে চাঁদের পাহাড়ের সঙ্করের মতো, কেউ কেউ নিজের স্বপ্নকে শেষ পর্যন্ত তাড়া করে বেড়ান। বুড়দা গ্রামের অক্ষয় ভকতও তাই।
টাকা-পয়সা জমিয়ে ২০১৮ সালের মার্চ মাসেই তিনি প্রথমবার ভারত ভ্রমনে বেড়িয়েছিলেন। বাল্য বিবাহ রোধের বার্তা নিয়ে ৪০১ দিন ধরে সাইকেলে ভারতের বেশ কিছু অংশ ভ্রমণ করে ২০১৯ সালের ১০ এপ্রিল বাড়ি ফিরেছিলেন অক্ষয়। তারপর তিনবছর কেটে গিয়েছে। ফের টাকা-পয়সা জমিয়েছেন অক্ষয়। কোভিড মহামারিও অক্ষয়ের বিভিন্ন সমাজ সচেতনতার বার্তা নিয়ে বিশ্ব ভ্রমণের স্বপ্নকে দাবিয়ে রাখতে পারেনি। চলতি বছরের জুলাই মাসের প্রথম সপ্তাহেই আবার তিনি সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পড়েছেন, এবার লক্ষ্য আরও বড় - বিশ্বভ্রমন।
আরও পড়ুন - মানুষ নয়, পুরুলিয়ার রাস্তায় গরু ধরলেন পুলিশকর্মীরা
আরও পড়ুন - লাদাখ ইস্যুতে রণে ভঙ্গ দিচ্ছে চিন, বিজ্ঞপ্তি জারি করে যৌথ বিবৃতির কথা জানাল ভারত
প্রথমেই তিনি গিয়েছেন লাদাখে। পৃথিবীর সর্বোচ্চ মোটরগাড়ি চলাচলের রাস্তা খারদুঙলা পাস (উচ্চতা ১৭৯৮২ ফুট বা ৫৩৫৯ মিটার) জয় করেছেন। তবে যাত্রাপথের এই অংশটা মোটেই সহজ ছিল না। অক্ষয় ভকত জানিয়েছেন, মানালির পর অনেকটা রাস্তা অত্যন্ত কঠিন ছিল। সারচু নামে এক জায়গায় প্রায় ৫ কিমি রাস্তা জুড়ে পুরু স্তরের ধুলো জমে ছিল। সেখান দিয়ে যাওয়ার সময় ধুলোয় কিছুই দেখা যাচ্ছিল না, দৃশ্যমানতা ছিল প্রায় শূন্য।
এরপর আরও একটা কঠিন গিরিখাত পার হতে গিয়ে সমস্য়ায় পড়েছিলেন অক্ষয়। অক্সিজেনের অভাব দেখা দিয়েছিল। শুনশান রাস্তায় অসুস্থ অবস্তায় পরিচয় পেয়েছিলেন এক সম্পূর্ণ অপরিচিত লাদাখি ড্রাইভারের বড় মনের। অসুস্থ অক্ষয়কে খুবই সহযোগিতা করেন তিনি। সাইকেল সহ তাঁকে ওই লাদাখি গাড়ি চালক গাড়িতে করে ওই পাসটি পার করে নিচে এক হোটেল পর্যন্ত পৌঁছে দিয়েছিলেন।
সেই হোটেলে বিশ্রাম নিয়ে সুস্থ হয়ে ফের চলা শুরু করেছিলেন পুরুলিয়ার যুবক। বিশ্বের দ্বিতীয় উঁচ্চতম গিরিখাত ট্যাংলাঙলা পেরিয়ে পৌঁছান লেহ-তে। খারদুংলা চড়ার সময়ও প্রচন্ড অক্সিজেনের সমস্যা হয়েছিল তাঁর। তা সহ্য করে উপরে পৌঁছেছিলেন যখন, সেখানে দুর্দান্ত তুষাড়পাত হচ্ছিল। সেইসঙ্গে কনকনে ঠান্ডা হাওয়া। সেই প্রতিকূল অবস্থাতেও বিশ্বের সর্বোচ্চ মোটরগাড়ি চলার মতো রাস্তা থেকে ভারতের তেরঙ্গা পতাকা তুলে ধরেছেন তিনি। এরপর কাশ্মীর, দিল্লি হয়ে তিনি যাবেন দক্ষিণ আফ্রিকায়।
জঙ্গলমহলের যুবক অক্ষয় ভকতের এই দুঃসাহসিক অভিযানের খবর পেয়ে অভিভূত পুরুলিয়াবাসী। জেলার মানুষ কুর্নিশ জানিয়েছেন তাঁকে। সেইসঙ্গে তাঁর ভবিষ্যৎ যাত্রার জন্য তাঁকে শুভেচ্ছা জানিয়েছেন জেলাবাসী।