‘সদাই ফকিরের পাঠশালা’-এ বার্ষিক ফি মাত্র ১ টাকা, আউশগ্রামে এখনও পড়াচ্ছেন পদ্মশ্রী সুজিত চট্টোপাধ্যায়

Published : Jan 05, 2023, 01:09 PM IST
Sujit Chattopadhyay

সংক্ষিপ্ত

“ওরা আমায় হাত জোড় করে জিজ্ঞেস করেছিল, ‘মাস্টারমশাই, আপনি কি আমাদের পড়াবেন?’ আমি বলেছিলাম, ‘আমি তোমাদের পড়াতে পারি, কিন্তু তোমাদের আমার সারা বছরের স্কুলের ফি দিতে হবে।’”

২০২৩ সালে এসেও একজন মাস্টারমশাই ছাত্রছাত্রীদের পড়াচ্ছেন মাত্র ১ টাকা মাইনেতে। সারা ভারত যাঁকে সম্মান জ্ঞাপন করেছে ‘পদ্মশ্রী’ হিসেবে, ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের কাছে তিনি বাংলার ‘এক টাকার মাস্টারমশাই’। তাঁর নাম সুজিত চট্টোপাধ্যায়। সেই অতি প্রিয় দুর্মূল্য শিক্ষাগুরু জানালেন নিজের শিক্ষাদানের সূচনা পর্বের কিছু কথা।

“যেদিন আমি আমার স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করি, আমি একটা মিনিটও নষ্ট করিনি। শিক্ষক হওয়ার জন্য অতি সত্বর আমার গ্রাম, বাংলার আউশগ্রামে ফিরে আসি। হ্যাঁ, বড় শহরের স্কুলগুলো থেকে আমার কাছে অনেক বেশি মাইনের চাকরির অফার এসেছিল, কিন্তু আমার জন্য, ১৬৯ টাকা মাইনের চাকরির প্রস্তাব দিয়েছিল আমার গ্রামের স্কুল। আমি আমার গ্রামের ছাত্রদের পড়ানোর জন্য উদগ্রীব হয়েছিলাম, যাদের একজন ভালো শিক্ষকের সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন ছিল। আমি এই স্কুলে ৩৯ বছর শিক্ষকতা করেছি এবং শুধুমাত্র অবসর নিয়েছি এই কারণে যে, আমি আমার 'অবসরের বয়স'- ৬০ পেরিয়ে গিয়েছি। এটা কিই হাস্যকর একটা ধারণা!

তাই, যখন আমার ৬০ বছর বয়স হল, তখন আমি অবসর নিয়েছিলাম এবং আশা করেছিলাম যে, আমার শেষজীবনটা চিনি দেওয়া চা খেয়ে চারপায়ায় শুয়ে অতিবাহিত করতে পারব! কিন্তু, ভেতরে ভেতরে আমি অস্থির হয়ে যাচ্ছিলাম। আমি তো অবসর নিতে চাইনি! তখন নিজেকে জিজ্ঞেস করতে থাকলাম, ‘আমি এখন কী করব?’ কয়েক দিন পর আমি এর উত্তর পেয়ে গেলাম।

একদিন সকাল সাড়ে ৬টার দিকে দেখলাম ৩ জন মেয়ে আমার বাড়িতে এসেছে। আমি ওদের কাছ থেকে এটা শুনে অবাক হয়ে গিয়েছিলাম যে, ওরা এই অবসর নেওয়া মাস্টারমশাইকে দেখতে ২৩ কিলোমিটারেরও বেশি রাস্তা সাইকেল চালিয়ে এসেছে! ওরা অল্পবয়সী কয়েকজন আদিবাসী মেয়ে, যারা শেখার জন্য আকুল হয়ে ছিল। ওরা আমায় হাত জোড় করে জিজ্ঞেস করেছিল, ‘মাস্টারমশাই, আপনি কি আমাদের পড়াবেন?’ আমি তো একথা শোনার সঙ্গে সঙ্গে রাজি হয়ে গেলাম। বললাম, ‘আমি তোমাদের পড়াতে পারি, কিন্তু তোমাদের আমার সারা বছরের স্কুলের ফি দিতে হবে। তোমরা কি দিতে প্রস্তুত?’ ওরা বলল, ‘হ্যাঁ, মাস্টারজি, আমরা যেকোনওভাবে টাকা ম্যানেজ করব।’


 

শুনে আমি বললাম, ‘হ্যাঁ, সারা বছরের জন্য আমার পারিশ্রমিক ১ টাকা!’ ওরা যে কত খুশি হয়েছিল! আমাকে জড়িয়ে ধরে বলেছিল, 'আমরা আপনাকে ১ টাকা তো দেবোই, সাথে ৪টে চকলেটও দেবো।’

আমি উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠেছিলাম। তাই, ওরা চলে যাওয়ার পর, আমি আমার ধুতিটা পরলাম এবং সোজা আমার স্কুলে চলে গেলাম এবং তাদের অনুরোধ করলাম যে, পড়ানোর জন্য দয়া করে আমাকে একটি শ্রেণীকক্ষ দেওয়া হোক। কিন্তু, স্কুল আমাকে ফিরিয়ে দিল। তবু, আমি তো দমবার পাত্র নই। আমার মধ্যে জেদ চেপে গিয়েছিল। তাই আমি বাড়ি ফিরে এসে নিজের বারান্দাটা পরিষ্কার করে নিয়ে সেখানে পড়ানো শুরু করার সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলাম।

২০০৪ সালে সেই ৩ জন মেয়েকে নিয়ে শুরু হয়েছিল আমার পাঠশালা। আজ প্রতি বছর আমি ৩ হাজারেরও বেশি ছাত্রছাত্রী পড়াই, যাদের বেশিরভাগই আদিবাসী মেয়ে। আমার দিন এখনও সকাল ৬ টায় শুরু হয় গ্রামের চারপাশে হেঁটে এবং তারপর আমি আমার দরজা খুলে দিই সারা দেশ থেকে আসা শিক্ষার্থীদের জন্য। কিছু মেয়ে ২০ কিলোমিটারেরও বেশি পথ পায়ে হেঁটে যায়। তাদের কাছ থেকে আমার অনেক কিছু শেখার আছে।

বছরের পর বছর ধরে, আমার ছাত্রছাত্রীরা প্রফেসর, বিভিন্ন বিভাগীয় প্রধান এবং আইটি পেশাদার হয়ে উঠেছে। তারা প্রায়শই আমাকে ফোন করে এবং আমাকে সুসংবাদ দেয়। আমি কিন্তু বরাবরের মতো ওদের অনুরোধ করি, দয়া করে আমাকে কিছু চকলেট পাঠিয়ে দিতে! গত বছর যেদিন আমি পদ্মশ্রী জিতেছিলাম, আমার ফোন বাজতে থাকা একটিবারের জন্য বন্ধই হচ্ছিল না। পুরো গ্রাম এসে আমার সাথে সেই আনন্দ উদযাপন করেছে। এটা একটা আনন্দের দিন ছিল, কিন্তু আমি তখনও আমার ছাত্রছাত্রীদের একটা ক্লাসও বন্ধ করতে দিইনি।

আমার দরজা সকলের জন্য উন্মুক্ত। যে কোনও সময় আমাকে এবং আমার পাঠশালাকে দেখতে আসুন। আমাদের গ্রাম সুন্দর এবং আমার সমস্ত ছাত্রছাত্রীরা অতি উজ্জ্বল। আমি নিশ্চিত যে, আপনি তাদের কাছ থেকে অনেক কিছু শিখতে পারবেন। আমি বাংলার একজন সাধারণ শিক্ষক যিনি নিজের চা এবং দুপুরের ভাতঘুমটা নিজের চারপায়ার ওপরে উপভোগ করেন। আমার জীবনের প্রধান উদ্দেশ্য হল প্রত্যেক মানুষের কাছে ‘মাস্টারমশাই’ হয়ে থেকে যাওয়া। এই পৃথিবীতে আমি শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত পড়াতে চাই।

২০২১ সালের পদ্মশ্রী বিজয়ী সুজিত চট্টোপাধ্যায় পশ্চিমবঙ্গের পূর্ব বর্ধমান জেলার ৭৮ বছর বয়সী অবসরপ্রাপ্ত স্কুল শিক্ষক। ‘সদাই ফকিরের পাঠশালা’ নামে তাঁর এক টাকা মূল্যের কোচিং সেন্টারটি সারা ভারত জুড়ে প্রভূত সমাদৃত।



আরও পড়ুন-
ত্রিপুরার রথ-রাজনীতিতে ‘জন বিশ্বাস যাত্রা’, অমিত শাহের উপস্থিতিতে বড় কর্মসূচি বিজেপির
দুর্গম সিয়াচেনে ভারতীয় সেনাবাহিনীর প্রথম মহিলা অফিসার, শত্রু মোকাবিলায় দুর্ভেদ্য ক্যাপ্টেন শিবা চৌহান

PREV
click me!

Recommended Stories

Murshidabad : নয়া মেরুকরণ! বেলডাঙায় যখন বাবরি মসজিদ, বহরমপুরে তখন রাম মন্দিরের শিলান্যাস
হুমায়ুন কবীর ৮০ লক্ষ টাকা খরচ করে বাবরি মসজিদের সূচনা করলেন, ব্যবস্থা 'শাহি' ভোজের