নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর নামে আজও রয়েছে যুদ্ধাপরাধীর তকমা। অথচ, পরমাণু বোমা হামলা করার পরও আমেরিকা যুদ্ধাপরাধী নয়।
সেটা ১৯৪৫ সাল। এরকমই এক ৬ অগাস্টের সকালে আমেরিকা নিয়েছিল সেই অভাবনীয় পদক্ষেপ, জাপানের হিরোশিমা শহরের উপরে ফেলেছিল পৃথিবীর প্রথম পরমাণু বোমা - 'লিটল বয়'। এর তিনদিন পর, আরও একবার একই কাজ করেছিল নাগাসাকি শহরে। মুহূর্তে দুই শহরের রাশি রাশি ইঁট-কাঠ-পাথর-সিমেন্ট-ইস্পাত বাষ্পের মতো উবে গিয়েছিল। অগুনতি মানুষের প্রাণ গিয়েছিল। মজার বিষয় স্রেফ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে বিজয়ী পক্ষে থাকার কারণেই এরকম ভয়ানক ঘটনা ঘটিয়েও পার পেয়ে গিয়েছে আমেরিকা। অথচ, দেশকে সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশদের হাত থেকে স্বাধীন করার লক্ষ্যে লড়াই করা নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর নামে আজও লেগে রয়েছে 'যুদ্ধাপরাধী'র নোংরা তকমা।
এই আলোচনায় ঢোকার আগে দেখা যাক কাকে বলে যুদ্ধাপরাধ বা War Crime. উইকিপিডিয়া বলছে, যুদ্ধাপরাধ এমন একটি কাজ যা যুদ্ধ আইনের গুরুতর লঙ্ঘনের ফলে ব্যক্তিগত অপরাধমূলক দায়ের জন্ম দেয়। যুদ্ধাপরাধের মধ্যে রয়েছে ইচ্ছাকৃতভাবে অসামরিক নাগরিকদের বা বন্দীদের হত্যা করা, নির্যাতন করা, অসামরিক সম্পত্তি ধ্বংস করা, বাজেয়াপ্ত করা, প্রতারণা করা, ধর্ষণ করা, শিশুদের সৈন্য হিসাবে ব্যবহার করা, লুণ্ঠন করা, এবং পার্থক্য, আনুপাতিকতা এবং সামরিক প্রয়োজনীয়তার নীতি গুরুতরভাবে লঙ্ঘন করা।
এখন দেখা যাক আমেরিকা কী যুদ্ধাপরাধী? সকলেই জানে, যুদ্ধটা শুরু করেছিল জাপানই। তখনকার জাপানি রাজা হিরোশিতো প্রশান্ত মহাসাগরের ওপাড়ে হামলা চালিয়েছিল। তারই জবাবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে সামিল হয়েছিল আমেরিকা। আর যুদ্ধটা শেষও করেছিল তারাই, পরমাণু বোমার বীভৎসতার সঙ্গে মানব সভ্যতার পরিচয় ঘটিয়ে। যদিও এর বীজ বোনা শুরু হয়েছিল তারও ৬ বছর আগে, ১৯৩৯ সালে। প্রথমে যা ছিল একদল মার্কিন বিজ্ঞানীর ব্যক্তিগত উদ্যোগ, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন, তাই সরকারি সমর্থন পেয়েছিল। তৈরি হয়েছিল ব্রহ্মাস্ত্র।
আমেরিকা কী জানত না, কী হতে চলেছে? তা তো নয়। সকলেই জানতেন কতখানি ভয়ঙ্কর পরিণতি হতে চলেছে জাপানি ওই দুই শহরের। যুদ্ধাপরাধের সংজ্ঞায় যে পার্থক্য ও আনুপাতিকতার কথা বলা হয়েছে, তা হল অসামরিক এবং সামরিক ব্যক্তিদের মধ্যে পার্থক্য করা এবং কত বেশি ক্ষতি ঠেকাতে কতখানি ক্ষতিসাধন করা হচ্ছে তার অনুপাত। দুই জাপানি শহরে ৭৬ বছর আগের ওই দুই বিস্ফোরণে ঠিক কত মানুষের মৃত্যু হয়েছিল, তা জানা যায় না ঠিকই। তবে, আশপাশের যে আনুমানিক সংখ্যাটা পাওয়া যায়, তা হল - হিরোশিমায় মৃত্যু হয়েছিল ৭০,০০০ থেকে ১,৩৫,০০০ মানুষের। আর নাগাসাকিতে ৬০,০০০ থেকে ৮০,০০০।
আরও পড়ুন - Hiroshima Day: ফিরে দেখা ভয়ঙ্কর সেই অতীত, পরমাণু বোমার ধ্বংসের ক্ষত বয়ে চলছে হিরোশিমা
বলাই বাহুল্য, এঁরা অধিকাংশই অসামরিক নাগরিক ছিলেন। এঁদের মধ্যে কেউ কেউ মারা গিয়েছেন বিস্ফোরণের কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে, কী ঘটছে, কীভাবে ঘটছে কিছু বোঝার আগেই তীব্র তাপে ঝলসে গিয়েছেন। আর বাকিরা পারমাণবিক বিকিরণে দগ্ধে দগ্ধে শেষ হয়ে গিয়েছেন কয়েক ঘন্টা থেকে কয়েক দিনে। তার পরের বেশ কয়েক প্রজন্ম ধরে দুই শহর ও তার কাছাকাছি এলাকায় জন্ম নেয় বিকলাঙ্গ শিশু।
এতবড় ক্ষতি হতে পারে জেনেও কেন পারমাণবিক বোমা আক্রমণ চালিয়েছিল আমেরিকা? সেই সময় মার্কিন প্রেসিডেন্ট ছিলেন হ্যারি ট্রুম্যান। তিনিই ম্যানহাটন প্রোজেক্টের বিজ্ঞানীদের পরমাণু বোমা হামলার নির্দেশ দিয়েছিলেন। তাঁর যুক্তি ছিল এতে করে আমেরিকানদের মৃত্যু কম হবে এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধও তাড়াতাড়ি শেষ হবে। সত্যি কথা বলতে তাঁর এই তত্ত্বও পুরোপুরি মেনে নেওয়া য়ায় না। কারণ, জাপানের একেবারে উপকন্ঠে অপেক্ষা করছিল রুশ সেনা। বস্তুত ৮ অগাস্টই স্টালিন জাপান াক্রমণের নির্দেশ দিয়েছিলেন। কাজেই জাপানের আত্মসমর্পণ সময়ের অপেক্ষা ছিল। মনে করা হয়, কমিউনিস্টরা জাপানের দখল নেবে, এই ভয়েই আগেভাগে পরমাণু আক্রমণ চালিয়েছিল আমেরিকা।
যদি, ট্রুম্যানের যুক্তি সত্যি বলে মেনে নেওয়াও হয়, তাহলেও পার্থক্য ও অনুপাতের হিসাবটা আমেরিকার ক্ষেত্রে ঠিক ছিল কী? তারপরও কিন্তু একজনও মার্কিন সামরিক বা রাজনৈতিক নেতা কিংবা বিজ্ঞানী - কাউকেই যুদ্ধাপরাধী হিসাবে চিহ্নিত করা হয়নি। অথচ, এই একুশ শতকে এসেও, যত বৃদ্ধই হোন না কেন, অক্ষশক্তির যে কোনও ব্যক্তিকে যুদ্ধাপরাধীর তকমা পেতে হয়। তাদের বিচার হয়, জেল হয়। সবথেকে বড় কথা, নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর মতো ব্যক্তিত্ব, যাঁকে ঘিরে শ্রদ্ধাবনত একটা গোটা উপমহাদেশের মানুষ, তাঁকেও বয়ে বেড়াতে হয় যুদ্ধাপরাধীর তকমা!
যদি, আমেরিকান রক্ত কম ঝরবে এই যুক্তিতে হ্যারি ট্রুম্যানের বোমা ফেলা যুদ্ধাপরাধ না হয়, তাহলে সুভাষ বসুও যুদ্ধ করেছিলেন ভারতের স্বাধীনতার জন্য। সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশদের সরানোর জন্যই হাত মিলিয়েছিলেন নাজি জার্মানি, সাম্রাজ্যবাদী জাপানের সঙ্গে। তাহলে কেন তিনি হবেন যুদ্ধাপরাধী? পরমাণু বোমা আক্রমণের মতো গুরুতর মানবতাবিরোধী অপরাধ করেও সম্পূর্ণ পার পেয়ে যাবে আমেরিকা? আজ কি তাদের মুখে আদৌ অন্যদেশের পরমাণু বোমা তৈরির প্রচেষ্টায় বাধ সাধা শোভা পায়? ৭৬তম হিরোসিমা-নাগাসাকি দিবসে এই প্রশ্নগুলো তুলতেই হবে।