খোদ ক্যাগ-এর দফতরের মধ্যেই নিগ্রহের শিকার বিশ্বনাথ গোস্বামী। একজন আরটিআই কর্মী হিসাবে তিনি ক্যাগ-এর দফতরে গিয়েছিলেন। কিন্তু, দিনের পর দিন নানা আছিলায় তাঁর করা আরটিআই-কে বানচাল করে দেওয়া হচ্ছিল বলে অভিযোগ।
ক্যাগ। যার ফুল ফর্ম করলে দাঁড়ায় কম্পট্রলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেল অফ ইন্ডিয়া। সংবিধানে উল্লেখিত স্বাধীন এই দফতরের কাজ কি? দেশের সম্পদ এবং জনগণের সমস্ত অবদানকে সঠিকভাবে কাজে লাগানো হচ্ছে কিনা তা খতিয়ে দেখা এবং সমস্ত সরকারি দফতর এবং তাদের সঙ্গে সম্পর্কিত সমস্ত অংশিদার এবং দায়িস্তপ্রাপ্ত আধিকারিক থেকে শুরু করে সহযোগীদের কাজ-কর্মের স্বচ্ছতা যাচাই করা। এই ক্যাগ-এর অডিট রিপোর্টের সুবাদেই নানা সময়ে নানা ধরনের দুর্নীতি সামনে এসেছে। আবার ক্যাগ-কে যে ভুল পথে কাজে লাগানো হয়েছে- এমন অভিযোগও বারবার সামনে এসেছে। এমনকী, ক্যাগ রিপোর্টেও অনেক আধিকারিক যে কারচুপি করেছেন- এমন অভিযোগও খুব একটা কম নয়। তবে, আজও দেশের মানুষের কাছে ক্যাগ এমন এক প্রতিষ্ঠান যা যে কোনও দুর্নীতির পর্দা ফাঁস করে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে। এহেন ক্যাগ-এর দফতরেই এক আরটিআই কর্মীকে নিগ্রহের অভিযোগ স্বাভাবিকভাবেই চাঞ্চল্য তৈরি করেছে।
এশিয়ানেট নিউজ বাংলাকে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে নিগৃহীত আরটিআই কর্মী বিশ্বনাথ গোস্বামী জানিয়েছেন, ২০১৮ সাল থেকেই বিভিন্ন বিষয়ে তথ্য জানার অধিকার আইনে তিনি কিছু তথ্য ক্যাগের কাছ থেকে চাইছিলেন। এর জন্য কলকাতায় হাইকোর্ট লাগোয়া এজি বেঙ্গলের দফতরে তিনি যাতায়াত করেছেন। কিন্তু, কোনও না কোনওভাবে তাঁকে তথ্য দেওয়া হয়নি বলে অভিযোগ করেছেন তিনি। নানা আছিলায় তথ্য দেওয়া হয়নি বলেও তাঁর অভিযোগ। তিনি আরও জানিয়েছেন যে, আইনের নানা অজুহাত দেখিয়ে আরটিআই-ক খারিজ করেছে ক্যাগের এই দফতর।
তিনি জানিয়েছেন, ৩০ নভেম্বর বিকেল ৪টা ১০ মিনিটে তিনি কলকাতা হইকোর্ট লাগোয়া এজি বেঙ্গল দফতরে গিয়েছিলেন আরটিআই-এর জন্য। তাঁর অভিযোগ, ক্যাগের বিভাগীয় অফিসার নিখিলকুমার মাজি-র কাছে যেতেই আইপিও-র অজুহাত দেখিয়ে আবেদন নিতে সরাসরি অস্বীকার করেন। কিন্তু, আইপিও বিধি উল্লেখ করে আবেদন গ্রহণের জন্য অনুরোধ করলে অশ্রাব্য ভাষায় গালিগালাজ শুরু করেন নিখিলকুমার মাজি। কেন তিনি বারবার আরটিআই-এর জন্য আবেদন করছেন তা নিয়েও নাকি ভর্ৎসন্যা করেন অভিযুক্ত ক্যাগ আধিকারিক। এমন অভিযোগও করেছেন বিশ্বনাথ গোস্বামী। একবার আইপিও কিনলে তার ভ্যালিডিটি ২ বছর থাকে বলে জানিয়েছেন আরটিআই কর্মী বিশ্বনাথ গোস্বামী। এমনকী আইপিও-র মেয়াদ শেষ হলেও তাতে সরকারের বলে দেওয়ার কিছু পদ্ধতি অনুসরণ করলেও মেয়াদ আরও ১ বছর বেড়ে যায়। অথচ, ক্যাগের আধিকারিক নিখিলকুমার মাজি এই সব না মেনেই কখনও আইপিও-র দোহাই দিয়ে আবার কখনও আইনে তথ্য দেওয়ার অধিকার নেই বলে হয় তা গ্রহণ করেননি অথবা আরটিআই-কে খারিজ করে দিয়েছেন বলেও অভিযোগ।
একান্ত সাক্ষাৎকারে বিশ্বনাথ গোস্বামীর অভিযোগ, তিনি ক্যাগের দফতর থেকে বেরিয়েই আসছিলেন, এমনই সময় নিখিলকুমার মাজি নাকি পিছন থেকে চিৎকার করে হুমকি দেন। অশ্রাব্য ভাষায় গালিগালাজ দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নাকি নিখিলকুমার মাজি নাকি বলেন, 'আরটিআই মারানো, জন্মের মতো ঘুচিয়ে দেব, মেরে মুখ ফাটিয়ে দেব'-- এশিয়ানেট নিউজ বাংলা-কে দেওয়া সাক্ষাৎকারে এমনটাই বলেছেন বিশ্বনাথ। নিখিলকুমার মাজি-র এমন হুমকি শুনে প্রতিবাদ করেছিলেন বিশ্বনাথ। ঘুরে গিয়ে তিনি নিখিলকুমার মাজি-র কাছে জানতে চেয়েছিলেন এমন কথা কেন বলছেন? এতো আরটিআই কর্মীদের উপরে আক্রমণ শুধু নয় ক্যাগের মতো এক দফতরের ভিতরে এমন ঘটনাও আশ্চর্যের যে এক ক্যাগ আধিকারিক হুমকি দিচ্ছেন। বিশ্বনাথের আরও অভিযোগ, এতে আরও ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন নিখিলকুমার মাজি, তিনি অর্ধস্তনকর্মীদের ডাক দেন এবং বিশ্বনাথকে শারীরিকভাবে নিগ্রহ করা হয় বলে অভিযোগ। কার্যত ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বিশ্বনাথকে ক্যাগের দফতর থেকে নাকি বের করে দিয়েছিলেন নিখিলকুমার মাজি এবং তাঁর সাঙ্গপাঙ্গরা। হেয়ারস্ট্রিট থানায় দায়ের করা অভিযোগ পত্রেও এই বিষয়টি উল্লেখ করেছেন বিশ্বনাথ।
হেয়ার স্ট্রিট থানায় নিখিলকুমার মাজিও পাল্টা এক অভিযোগপত্র দায়ের করেছেন এবং বিশ্বনাথ গোস্বামী আরটিআই দায়ের করার মধ্যে দিয়ে বিশৃঙ্খলা তৈরির চেষ্টা করছেন বলেও নাকি তাতে অভিযোগ করা হয়েছে। বিশ্বনাথ গোস্বামী জানিয়েছেন, তথ্য জানার অধিকার আইন দেশের জনগণের এক মৌলিক অধিকার। তাই আরটিআই দায়ের করার মধ্যে দিয়ে কি বিশৃঙ্খলা তৈরি করা হচ্ছে তা বোধগম্য হচ্ছে না। তাঁর আরও অভিযোগ, নিখিলকুমার মাজির কাছে তিনি শেষ যে আরটিআই দাখিল করেছিলেন তাতে তিনি জানতে চেয়েছিলেন যে এখনও পর্যন্ত ক্যাগের এই আধিকারিক কতগুলো আরটিআই গ্রহণ করেছেন এবং কতগুলো আরটিআই-এর জবাব দিয়েছেন ও কতগুলো আবেদন বাতিল করেছেন? বিশ্বনাথ গোস্বামী জানিয়েছেন, তাঁর এই আরটিআই-এই মেজাজ হারান নিখিলকুমার মাজি। বিশ্বনাথ গোস্বামীর মতে, তিনি নিশ্চিত যে নিখিলকুমার মাজি অধিকাংশ আরটিআই বাতিল করেছেন। এই রেকর্ড যদি প্রকাশ্যে আসে তাহলে ক্যাগের স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে বাধ্য।
বিশ্বনাথ গোস্বামী একান্ত সাক্ষাৎকারে আরও জানিয়েছেন যে, ক্যাগের দফতরে সেদিন নিখিলকুমার মাজি তাঁকে ভিখারি বলেও গালিগালাজ করেন। আরটিআই-করে বের করা তথ্য বেচে তিনি খান বলেও নাকি মন্তব্য করেছিলেন নিখিলকুমার মাজি। এমনও অভিযোগ করেছেন বিশ্বনাথ গোস্বামী। এমনকী, ক্যাগের দফতর থেকে বেরিয়ে কলকাতা হাইকোর্টের পাশে দাঁড়িয়ে তিনি আরটিআই-এর তথ্য বেচে দিন বলেও নাকি নিখিলকুমার মাজি গালিগালাজ করেছিলেন বলেও অভিযোগ।
বিশ্বনাথ গোস্বামীর মতে, একজন ক্যাগ আধিকারিক কীভাবে এত অশ্রাব্য-অশ্লীল হতে পারেন তা কোনওভাবেই বোধগম্য হচ্ছে না। হেয়ারস্ট্রিট থানায় ইতিমধ্যেই হাজির হয়ে তাঁর বয়ান দিয়েছেন বিশ্বনাথ। কিন্তু, এতপরও কোনও এফআইআর দায়ের করেনি পুলিশ। সুপ্রিমকোর্টও আরটিআই কর্মীদের নিরাপত্তা বজায় রাখার জন্য কেন্দ্রীয় সরকারকে নির্দেশ দিয়েছিল। নিশ্চিতভাবেই এই নিরাপত্তা পুলিশ-প্রশাসনের হাত দিয়েই বলবৎ হতে হবে। কিন্তু, আরটিআই কর্মী বিশ্বনাথ গোস্বামীর নিগ্রহকাণ্ডে যেভাবে পুলিশ এক নিস্ক্রিয়তার উদাহরণ খাড়া করেছে তাতে আরটিআই কর্মীদের নিরাপত্তা কতটা সুনিশ্চিত হচ্ছে তা নিয়ে হয়তো সুপ্রিমকোর্টে আরও একটি মামলা দায়ের হতে-ই পারে।
আরও পড়ুন-
কেটে গিয়েছে ৪৮ ঘণ্টারও বেশি সময়, আরটিআই অ্যাক্টিভিস্ট বিশ্বনাথ গোস্বামীকে নিগ্রহকাণ্ডে এখনও এফআইআর দায়ের করল না কলকাতা পুলিশ
CAG অফিসে আক্রান্ত আরটিআই অ্যাক্টিভিস্ট বিশ্বনাথ গোস্বামী, ২ দিন পরে অভিযোগ গ্রহণ পুলিশের
শীতের আমেজের মাঝেই ঊর্ধ্বমুখী তাপমাত্রার পারদ, ডিসেম্বরেও কি কনকনে শীত পড়বে না বঙ্গে?